দিলীপ মহান্তীর গুচ্ছ কবিতা
বসন্তের গান
দিনগুলি ঝরে বৃন্তের ডগা থেকে
ওই দেখো দূরে কৃষ্ণচূড়ার সারি
একদিন যার হাওয়া লেগেছিল গায়ে
পথ মাখে শুধু রক্তিম পদধূলি;
পাতা উড়ে আসে জলের গন্ধ মেখে
নদীদের পাড়া আকাশের কোন পারে
তীরগুলি ভাঙে স্রোতের তীব্র ঘায়ে
বালিদের বুকে ফাল্গুন জমে আছে।
রাধা
কখনো কখনো আগ্নেয়গিরি জাগে
নির্গত হয় গলিত লাভার স্রোত
মনে করো সে সব প্রহর জেগে
লিখছি কবিতা বৃষ্টি আনার ভোর;
তুমি এনে দেবে আমার আষাঢ় মাস
তুমি এনে দেবে যক্ষের আকুলতা
স্বপ্নে ভাসবে দূরের অলকাপুরী
দুয়ারে দাঁড়াবে বৃন্দাবনের রাধা।
পথের গান
যে রঙিন সাঁকো একা পড়ে আছে
তলদেশে জলরেখা,
তার দুই তীরে ক্ষোভ জমে আছে
নিষিদ্ধ পথরেখা!
যে উঠোনে একা রোদ নেমে আসে
ভেতরে অন্ধকার,
তার বিরুদ্ধ দেয়ালের গায়ে
হাওয়ারা নিরুত্তর!
রাত্রির গান
নীল একপাতা উড়ে উড়ে যায়, এ সময় নির্জন
বহু দূর থেকে গড়িয়ে পড়েছে গভীর রাতের ঘ্রাণ!
আকাশ এসেছে নেমে রাস্তায়, সন্ধ্যাতারাও একা
জনহীন দিঘি মন্দিরে তালা নদীর সঙ্গে দেখা!
বাতাসের মৃদু বিশ্বাস দোলে রজনীগন্ধা বনে
রাতজাগা পাখি রক্ত চক্ষু দীর্ঘ প্রহর গোনে!
কত প্রতীক্ষা আকাশের মেঘে নীল রাত্রির টানে
ভাসাক পৃথিবী মৃত্যু আসুক তীব্র স্রোতের গানে।
কাঁটাতার
চারদিকে কত বিষাক্ত হাওয়া বারুদ উড়ছে মেঘে
পাতাগুলি হলুদ হয়েছে অস্থির দিন মেখে!
কান পেতে শোনো সাইরেন বাজে সীমান্ত নির্বিকার
হিংসার ধ্বনি রোদে ঝরে পড়ে ঝলসায় কাঁটাতার!
এরই মাঝে দেখো তুমি বসে আছো আকাশ ভাসছে চোখে
রূপকথাগুলি হারিয়ে গিয়েছে প্রবল শীতের রাতে!
টিভির পর্দা ভেসে উঠে মনে যুদ্ধের রণসাজ
চিরকাল বুঝি আঁধারে ভাসছে পিছনের পরিবার!
ঝর্ণা
ঝর্ণার জল পাথরের কাছে এসে
দিতে চেয়ে ছিল তার গোপন কথা
সময় শুধু নির্বাক চেয়েছিল
হাওয়ায় হাওয়ায় দীর্ঘশ্বাস কাঁপা
প্রতীক্ষা আর অনাদর চোখে বেঁধে
নৈঋত কোণে ঘন কালো মেঘ জমা
অকাল বর্ষা ভাসিয়েছে মাঠ ঘাট
নদী চলে গেছে সাগরের কাছে একা।
রাত্রির চিঠি: ১
পাহাড়ের চোখ সমতলে ঘোরে নদীরেখা দূরে সরে
বহু সময়ের লোভ অপচয় ঘাসের শিশিরে ঝরে...
ঘুমহীন চোখ দূরের আকাশে কোন তারা খুঁজে যায়
ক্লান্ত সকাল হাওয়ায় হাওয়ায় না পাওয়া চিঠি পাঠায়!
দিবসের তাপে ফুল ঝরে যায় ভাষা থামে ঠিকানায়
দগ্ধরাত্রি কেঁপে কেঁপে ওঠে নিষিদ্ধ এক কামনায়!
রাতজাগা নদী তরোয়াল খোলে দিগন্ত পাহারায়
সাগরের ঢেউ নোনা হাওয়া এনে সৈকত সামলায়।
রাত্রির চিঠি: ২
শীতকাল জুড়ে শুষ্করাত্রি শিশির পড়েছে ঝরে
তীব্র ব্যথায় ক্লান্ত চোখেতে চাঁদ ডুবে যায় ঘাসে;
তুমি বিছানায় নীরবে ঘুমোও রোদের ইশারা মেখে
মনেও পড়েনা নদীস্রোতে কার গোপন স্পর্শ ভাসে...
ঝরে পড়া ফুল মাটির ওপর নিশ্বাসখানি কাঁপে
হাওয়ায় হাওয়ায় নীরব রাত্রি বয় সকালের ঘাটে;
দিগন্ত থেকে মিছিল চলেছে তারার আসা যাওয়া
আকাশব্যাপী দীর্ঘ বর্ষা মেঘেরা লিখেছে মায়া।
দুঃসময়
দু'চোখ ভরে অরণ্যের স্বাদ
পায়ের পাতায় সমুদ্রের নুন
আমরা দেখেছি পাহাড়ের গাঢ় রং
হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে যায় ফাল্গুন...
বুনে যাওয়া সেই মাকড়সার জাল
এককোণে বসে শিকারের সন্ধান
প্রতিবেশীদের চোখে নেমে আসে রাত
আমরা দিয়েছি অনেকের ঘরে ত্রাণ।
রাজপথ দিয়ে জন্তুরা হেঁটে যায়
খিদেয় বাতাস হিংস্র অজগর
চারদিকে কত প্রজাপতি ডানা মেলে
ফাঁকা প্রান্তরে রজনীগন্ধা ফোটে।
দিনগুলি ছুটে ক্লান্ত মিছিল ধরে
আকাশের দিকে মরা মানুষের হাত
ধুলো ওড়া পথে অকাল সন্ধ্যা নামে
রাত্রিও চায় শুধু একমুঠো ভাত।
অনুশোচনা
তুমি ডুবে যাও ঘোলা জল ঘেরা অনুশোচনার খালে,
অপেক্ষার তপ্ত আগুনে সেঁকে নাও দুটি হাত
পৃথিবীর আরো ঝলসানো রূপ
পুরে নাও ক্ষোভে, রিক্ত দু'চোখ মেলে...
চারপাশে কত রোদ নিয়ে আছি
হাওয়াকে জড়িয়ে রেখে
সরে গেছে দীর্ঘ ধুলোর ঝড়
সাগরের করতলে;
নীল জল মাখে মরুভূমি মেঘ
আকাশে বাজনা বাজে
তুমি বসে থাকো ক্যাকটাস বনে
শীতকে জড়িয়ে রেখে।
মধ্যরাত্রির কথকতা
মধ্যরাত্রি সংকেতে কাঁপে কতদূরে নদীজল
দীর্ঘ প্রহর জেগে রয় একা অমাবস্যার ক্ষণ
দু'পাশের বালি টেনে নেয় ঘূর্ণায়মান স্রোত
দেরি হয়ে গেছে পথ দুর্গম ঠিকানা অন্তহীন।
জেগে থাকা রাত,আরো নির্জন, দগ্ধ হাওয়ায় কাছে
নিশাচর তারা চুপি চুপি যায় রজনীগন্ধা বনে
কত কত মাঠ রিক্ত হৃদয়ে লিখে রাখে অভিমান
তারায় তারায় মহাকাশ জুড়ে ক্রমে প্রকাশকাল।
নদী হয় বড়,রাত্রিরা ক্ষীণ, রুগ্ন ভোরবেলায়
হাওয়া ছুটে আসে নীরবতা ভেঙ্গে ক্লান্ত মেঘের দল
অস্ফুট আলো হেসে হেসে পড়ে পাতাদের স্বরলিপি
পাখি উড়ে গেছে আকাশের বুকে ডানাদের করতালি।
দেশের বাড়ি
সব রাস্তায় আলপনা আঁকা মুখ
দরজায় ঝোলে আমন্ত্রণের লিপি
বাড়ি গুলো যেন কথা বলে ওঠে হেসে
জ্যোৎস্নায় ধোয়া উঠোন ডাকছে কাছে।
পথে খেলা করে ধুলোমাখা কিছু ছেলে
কিছু ছেলে গেছে জঙ্গলমাখা রোদে--
মানুষের চোখে আর্তনাদের ছবি
বিশ্বাস শুধু গাছের ডালে ভাসে!
আ়ঁধার রাত্রি নীরবে বইছে জলে
তারাদের মুখে ব্যাকুল গানের কলি
ঘরছাড়া হাওয়া লুকোয় সবুজ ভিড়ে
পথে পথে কত ঝুমুর গান ওড়ে।
অভিনিবেশ
মনোজ বাগ
কত খানা খন্দ অলিগলি তস্য গলি হয়ে চলেছি ...
একটা সোজা রাস্তা, জন্ম জীবন মৃত্যু
তবু তাতেও কত ঘুরপাক!
দেখছি একটি একটি মানুষ,
একটি একটি মানুষের গতি - প্রকৃতি
দেখছি, একটি একটি রাস্তা,
কত সহজ সরল মানুষ।
কত জটপাকানো রাস্তা।
দেখেছি রাস্তা স্বল্প দৈঘ্যের হলে সে অন্য কথা,
কিন্তু যে রাস্তা সুদীর্ঘ তাতে আছে অনেক অনেক বাঁক , উঁচুনিচু
আছে অনেক অনেক পথশ্রান্তি ,
দেখেছি , মুহূর্তের দেখায় যা সহজ সরল মনে হয়।
দীর্ঘ সময় থাকতে থাকতে তারও কাঠিন্য চোখে পড়ে
চলা যত দীর্ঘ হয়, দেখা শোনার বোঝার এই সঞ্চয়
ততই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।
তারপর কোন একদিন মনে হয় দূর্ আর না -
ঝোলাঝুলি সব খালি করে
গিয়ে দাঁড়াই চারদিক খোলা কোন সমুদ্র সৈকতে
এক সমুদ্র জলের নীল আর
এক আকাশ শূন্য
যে ক্ষীণ একটি রেখায় মিশে আছে
তার দিকে অপলক হয়ে চেয়ে থাকি।
আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে অনেক মানুষ পশুপাখি, লাল কাঁকড়া, তারামাছ, জেলি
বালিতে পড়ে থাকা কত হাজারো রকমের ঝিনুক ...
সারা দিনের শেষে তবুও খুবই সামান্য মনে হয় এই দেখা।
গোধুলির আকাশ যখন কিছুটা লালাভ।
সিঁদুর রঙের ডুবন্ত সূর্য আমাকে শিক্ষা দেয়-
যে কোন অভিনিবেশই একটু আধটু নয়
সমগ্র জীবন দাবি করে।
যেমন শিল্প সাহিত্য যেমন প্রিয়জন
সবাই সব্বাই।
আমি স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকি ...
বিশ্রামাগারশুভায়ু দে
চার দেওয়ালের একটা ঘর,মাঝে একটা বিশ্রামঠেক।
যাদের ঘর নেই,আকাশ টাকে চৌকো হিসাবে ধরতে পারে।
চার কোণা স্কাই কালারের ভারচুয়াল দেওয়াল।
ফ্লোরে শূন্যতা নামক ফুটপাত অথবা জলপ্রদেশ।
নৌকার ছইয়ের দেওয়ালের মাঝে একটা মাঝি বসে।
তার পিঠেও রাত্রি নামে,স্পন্ডেলাইটিস এর ব্যথায়।
নক্ষত্র সারারাত খালি পিঠে ট্যাটু বানায়।
জলের রাজার পিঠ।
চুল্লির মালিককেও মাঝি বলা যেতে পারে।
শ্মশানের শয়নকক্ষের কোনো বেওয়ারিশ লাশকে,
অগ্নিসংযোগে অন্য মহাদেশে পাঠিয়ে দেয়।
রাত হলেই শুতে হবে তার মানে নেই।
ওরা যখন ঘুমিয়ে পড়ে,সেটাই একেকটা রাত।
একেকটি খাটের পা ধরে পড়ে থাকে নাছোড়বান্দা রাত।
নিজের আইসোলেশনে ঠুমকা ঠুমকা হেঁটেছি
অভিজিৎ দাসকর্মকার
চিত্রকলার নিচে শব্দের ঠিকানা, আর
চিরদিনের ধ্রুবতারা ঘুলঘুলিতে অন্ধকার অন্ধকার চুপি দেয়।
সমকোণ সূচিত করো, যদিও টেঁড়া মেড়া কপাল লেখা
সিঁদুরের কৌট আনো বলে করমর্দন করছে ইয়াল্লা শুকু শুকু
শরীর দিয়ে চলে যায় নিখিলবঙ্গের টসটসে বৃষ্টি।
জেরবার হচ্ছো?
আমিও তো বুঁদ গ্লাসের নেশায় কাৎরা কাৎরা ডুবেছি। রাস্তার লজিক্যাল ক্র্যাকে জাঁকিয়ে বসে দুঃখের সমীকরণ চিবোতে চিবোতে, আবার
নিজের আইসোলেশনে ঠুমকা ঠুমকা হেঁটেছি
আচ্ছা গন্তব্যের যে পাণ্ডুলিপিটা পাশের দেহে নির্যাস হয়ে একে একে একটা দুপুরের একদিকে অসন্তুষ্ট হচ্ছে
তার থ্যাঁৎলানো চামড়ার গভীরে ওভারডোজের আরাম রুয়েছে যাপনের কৌশল ———
বাদ দাও। এখন ৩:৪০-এর বিকেল।
টেবিলক্লথটায় বিচ্ছিন্ন সময়ের যে অনুলিপি এনেছি তাতে ১৪ আগস্টের তারিখ সহ পাতো--
আরে মেচেন্টা রঙের ব্লাউজ পরো। দ্যাখো চোখের ভিতর মৌন মিছিলে আমি নিদারুণ নিঃসঙ্গ,
টিভি খোলা। চূড়ান্ত কবিতারা বিষমবাহু ত্রিভুজ এবং সাদা সোমবার পালন করছে
যম
সুজিত রেজ
হে নচি, আমার বাহুবন্ধন খুলেছি
তোমার মুষ্টি বাড়াও। আজানুলম্বিত বাহুমূল
চেপে ধরো বৈদ্যুতিক ক্ষিপ্রতায়
নচিকেতাতালের এ পার ও পার জুড়ে
মৃত্যুর ও পারে কোন স্টেশন অপেক্ষমাণ
সে প্রশ্ন এখন যাদুঘরে
আমার কৌতূহল স্বতন্ত্র
আর কতদিন এই খাণ্ডবদাহন
সন্ত্রাস-লাশের উৎকট প্রদর্শনী
এত কেন ক্ষুৎকাতর তুমি
হে নরকশ্রী , কী চাও তুমি হে প্রসাদপিতা
ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের তিন সূক্ত কি অহৈতুকী
হে বৃক্ষবাসী বিবস্বান-জাতক
সংহর--- সংহর মহাচন্দ কালপুরুষকে
অপরিচিতের মুখ
রূপক সান্যাল
পাশ ফিরে শোওয়া আমার আর হলো না
নির্জনতা কিনে কিনে একদিন ফতুর হয়ে যাবো
শেকড় কিংবা শাখায়, কোথাও বাড়বৃদ্ধি নেই
আমার কান্ড চিরেই একদিন আমাকে পোড়াবো
বাবাও জীবনভর এভাবেই নিজেকে পোড়ালো
শ্মশানের কাছে রয়ে গেছে মানুষের নিরবচ্ছিন্ন ঋণ
একথা সবাই জানে, বর্তমান ক্রমশ অসহ্য হয়ে ওঠে
বয়স বাড়ার সাথে অতীতকে মনে হয় দারুণ রঙিন
দুপুর গড়িয়ে গেলে সকলেই পাশ ফিরে শুতে চায়
নতুন দেওয়ালের গায়ে নিজস্ব নামটা লিখবো না?
কোনোদিন তোমার সামনে অস্পষ্ট শরীরে দাঁড়ালে
জানি না, আদৌ আমাকে চিনতে পারবে কিনা?
অলঙ্করণ : দয়াময় বন্দ্যোপাধ্যায়
খুব ভালো কবিতা পড়লাম। শব্দযোজনা ছাড়াও কবিত্বের দিকটি প্রশংসা দাবি করে। ধন্যবাদ কবি এবং সম্পাদককে।
ReplyDeleteখুব ভালো কবিতা পড়লাম। শব্দযোজনা ছাড়াও কবিত্বের দিকটি প্রশংসা দাবি করে। ধন্যবাদ কবি এবং সম্পাদককে।
ReplyDeleteকবি দিলীপ মহান্তীকে শুভেচ্ছা জানাই
ReplyDeleteপড়লাম। প্রতিটি কবিতাই চমৎকার। আরো ভালো লাগলো এই কারণে পরপর বিভিন্ন কবির বিভিন্ন আঙ্গিকে সাজানো কবিতা পড়তে পারলাম। সাজানোটা বেশ
ReplyDeleteকবিতা গুলো খুবই সুন্দর। প্রণাম জানাই মহান্তী স্যারকে।।।
ReplyDeleteঅনেক দিন পর দিলীপদার কবিতা পড়লুম। বরাবর যেমন ভালো লাগতো, আজও তাই লাগলো। ভীষণ ভীষণ ভালো লাগলো।
ReplyDeleteদীপুদা, ( দিলীপ মহান্তী ) কবিতাগুলো এতো সুন্দর যে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। দারুণ হয়েছে।
ReplyDeleteদীপুদা (দিলীপ মহান্তী), অনেক দিন পর একগুচ্ছ মনভরানো কবিতা পড়ে খুব ভালো লাগলো। এরকমই সুন্দর লিখে যাও, এই কামনা করি।
ReplyDelete