সাঁঝবাতি ব্লগজিন

Monday, August 31, 2020

প্রবন্ধ

রাঢ়ের শৈব ধর্ম : মানব সভ্যতার আদি ধর্ম

উত্তম চক্রবর্ত্তী 

পৃথিবী কৃষ্ণ জলে সমাচ্ছন্ন। সেই অদিকালে এই মহাসমুদ্রের না ছিল নাম, না ছিল পরিচয়। কে দেবে নাম? তখন তো মানুষের আবির্ভাব ঘটে নি। এই সাগরের মাঝে যে ঊষর ভূমি গুলি ছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল রাঢ়। রাঢ় দেশ। কালের গতি এগিয়ে চলল। ঝড় বৃষ্টি তে রাঢ়ের ভূমি ক্ষয় হতে হতে পর্বত গুলির উচ্চতা কমতে লাগল।অবক্ষয়ে পর্বত গুলির মাথায় সঞ্চিত বরফ ঝরে পড়ল। রাঢ়ের নদী গুলি পূর্ব বা দক্ষিণ -পূর্বে বহে যাওয়ার সময় ক্ষয়জাত পালি বালি পূর্ব রাঢ়ে সঞ্চয় করে তরঙ্গায়িত ভূমির সৃষ্টি করে। কালের প্রবাহ পথে আজ থেকে প্রায় দশ লক্ষ বছর আগে মানুষের আবির্ভাব ঘটে। মানুষ রাঢ়ের বন জঙ্গলে বসবাস করতে থাকে। খাদ্যের চাহিদা তারা ক্রমশ পশ্চিম রাঢ় থেকে পূর্ব রাঢ়ের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। 

রাঢ় বলতে পশ্চিম রাঢ় যাহা সাঁওতাল পরগনা,, বীরভূম, পশ্চিম বর্ধমান, ইন্দাস থানা বাদে বাঁকুড়া জেলা, মানভূম, রাঁচী জেলার সিল্লি, সোনাহাতু, বুন্ডু-তামাড়, সিংভূম জেলা এবং মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমাংশ।

পূর্ব রাঢ়ের মধ্যে পশ্চিম মুর্শিদাবাদ, বীরভূমের উত্তরাংশ, পূর্ব বর্ধমান, হুগলি, হাওড়া, পূর্ব মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া জেলার ইন্দাস থানা। মোটামুটি এই ছিল রাঢ় ভূমি। 

রাঢ় অঞ্চলের মানুষ পশুচারণ শিখল, চাষবাস শিখল। ধীর গতিতে এগিয়ে চলল সভ্যতা। রাঢ়ের ফাগুন মাসের আগুন ঝরা রূপ। মানুষের রক্তে নাচন ধরায়। সে আজ অনেক বছর আগের কথা। তারা নিশ্চয় তপস্যা করেছিল। কে তাদের তপস্যা শিখিয়েছিল? 

তাদের অন্তরের প্রাণপুরুষ তপস্যা শিখিয়েছেন, তিনি হলেন সদাশিব। ভারতে তখন আর্যরা আসতে শুরু করেছে, এমন সময় রাঢ়ে জন্মেছিলেন রাঢ়ের প্রাণপুরুষ সদাশিব। তাঁরই জিয়ন কাঠিতে মানুষ সভ্যতার ধারাতে মিলিত হল। 

আজ থেকে প্রায় সাড়ে সাত হাজার বছর আগে সদাশিবের আবির্ভাব ঘটে। এই বিরাট মহাপুরুষ মানব জাতির কল্যাণে উদার শৈব ধর্ম প্রবর্তন করেন, রাঢ় সেই শৈব ধর্মকে সর্বতোভাবে তার প্রাণীন সম্পদে পরিনত করে। অন্যরা রাঢ়ে আসার আগে থেকেই দীর্ঘদিন ধরে রাখে চলেছিল উদার শৈব ধর্ম। 

রাঢ়ে তথাকথিত নিম্নবর্ণে শৈব মতে বিবাহ এখনও প্রচলিত আছে। বর-বধূর মালা বদল হলে, বর কনেকে কিছু ধান দেয়। ধান দেওয়ার অর্থ - আমি কনের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিলাম। এর পর বর কনের মাথায় কিছু সিঁদুর ঢেলে দিল। এই ভাবে সহজ সরল অনাড়ম্বর পরিবেশে কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিবাহ সম্পন্ন হয়ে পড়ে। 

এই হল উদার শৈব মতবাদের অন্যতম নিদর্শন। 

সদাশিব মূর্তি পূজা সমর্থন করতেন-- এর কোন প্রমাণ নেই। কিন্তু শিবের তিরোভাবের পর সমাজে দেখা দিল এক বিশেষ ধরনের পূজা পদ্ধতি - লিঙ্গ পূজা। এই লিঙ্গ পূজার মধ্যে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক প্রয়োজনে একটা সুন্দর বিমিশ্রণ ছিল। গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে তখন চলত পরিচ্ছেদহীন সংগ্রাম। সকল গোষ্ঠীই নিজেদের সংখ্যা বাড়াতে চাইত। তাই সংখ্যা বৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে তারা প্রথম লিঙ্গ পূজার প্রবর্তন করেছিল। 

পরবর্তী কালে এই লিঙ্গ পূজাকে আধ্যাত্মিকতায় উদ্বুদ্ধ করা হয়। সে যুগের মানুষের ধ্যান ধারনা ছিল সহজ সরল, কিছুটা স্থূলও ।তাই তারা পুরুষ প্রকৃতির ভাবটা নিয়ে  (শিব-শক্ত্যাত্মকং ব্রহ্ম) তারা লিঙ্গপূজার প্রচলন শুরু করছিল। এই লিঙ্গপূজাই পৃথিবীর আদিমতম পূজা পদ্ধতি। সমাজতত্ত্ববিদরা  এটাকে ধর্মের পথে প্রথম পদক্ষেপ বলে মনে করেন। 

রাঢ়ের বহুস্থানে এ ধরনের অজস্র শিবলিঙ্গ ছড়িয়ে রয়েছে। প্রায় প্রতিটি গ্রামেই যে শিব মন্দির দেখতে পাওয়া যায় তাদের অনেক গুলি আড়াই থেকে সাত হাজার বছর পুরানো। এদের মধ্যে বাঁকুড়া জেলার এক্তেশ্বর ,পুরুলিয়ার বুধপুরের বুদ্ধেশ্বর,টুশ্যামার বাবা আদিনাথ, মানবাজারের নিকট বড্ডি গ্রামের পরেশনাথ, যা কংসাবতী জলাধার নির্মানের সময় কংসাবতী পাড়ের উপর স্থাপিত করা হয়, পায়রাচালী গ্রামের ভগড়ার বুঢ়া বাবা, হুগলির তারকেশ্বর প্রভৃতি লিঙ্গের নাম উল্লেখ করা যায়। 

আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে রাঢ়ে জৈন ধর্ম ও বুদ্ধ ধর্মের বিকাশ ঘটলেও, সাড়ে ছ'শো খ্রীষ্টাব্দে রাঢ়ের স্বাধীন শৈব রাজা শশাঙ্ক বহু জৈন ও বুদ্ধ মূর্তি ভেঙে পুনরায় শৈব ধর্মকে তার নিজের আসন ফিরিয়ে দেন। আজও রাঢ়ের ব্রতকথায় ঘুরে ফিরে কেবলই শিবের মাহাত্ম্য প্রচারিত। রাঢ়ের চড়ক, গাজন, ও বোলান উৎসব সম্পূর্ণত শিবকেন্দ্রিক।

তথ্যসূত্র - সভ্যতার আদি বিন্দু রাঢ়।

ছবি : দয়াময় রায় 

2 comments:

  1. পড়ে ভালো লাগলো। অনেক অজানা তথ্য পেলাম।তবে বৌদ্ধ ধর্ম জৈন ধর্ম অপেক্ষা অনেক নবীন।বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা গৌতম বুদ্ধ চব্বিশ তম জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীরের সম সাময়িক।

    ReplyDelete
  2. খুব ভাল লাগল ।

    ReplyDelete