Monday, August 31, 2020

ধারাবাহিক

নাটক থেকে লেখক

অরূপম মাইতি

কলকাতার স্কটিশ কলেজের পড়ুয়া এক দল ছেলে ঠিক করল, নাটক করবে। নাটক লেখার দায়িত্ব দেওয়া হল দলের এক সদস্যকে। পড়তে গিয়ে দেখা গেল, নাটক হয়নি। দলের একটি ছেলে, নাম সুব্রত পরামর্শ দিল,  আগে গল্প লিখে, তাতে নাট্যরূপ দিলে ঠিক হবে। যেমন কথা তেমন কাজ। তরুণ লেখক রাত জেগে গল্প লিখলেন। তারপর তাকে নাট্যরূপ দিলেন। দলের সবাই বলল,  গল্প তো হয়েছে, তবে এ নাটক করা যাবে না। 

পরপর দু-বার উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ ছেলেটিকে চাঙ্গা করতে আবার ত্রাতার ভূমিকা নেয় সুব্রত। পরামর্শ দেয়,  গল্পটি কোন পত্রিকায় দিলে নিশ্চয় ছাপা হবে। তরুণ লেখক স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। কোন পত্রিকায় দেবে, ঠিক করতে গিয়ে খানিক ধন্দেও পড়ে। নিজেই সিদ্ধান্ত নেয়,  পয়লা নম্বর পত্রিকাতেই সে লেখাটি পাঠাবে। 

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের কোনও লেখাতে সে পড়েছিল, ‘শুরু করা উচিত চূড়া থেকে...’। চূড়া বলতে তখন ‘দেশ’ পত্রিকা! তবে সেখানে তাবড় তাবড় লেখকেদের ভিড়। কে না আছে!  বিমল মিত্র থেকে তারাশঙ্কর, তাদের সাথে বিমল কর এবং তাঁর বিখ্যাত দশজন শিষ্য,  রতন ভট্টাচার্য শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। শিষ্যদের নিয়ে বিমল কর হামেশা হয় বসন্ত কেবিন নয় কলেজ স্ট্রীটে বসতেন। পরে এঁদের আড্ডা উঠে এসেছিল কার্জন পার্কে।

তরুণ লেখক একদিন ‘দেশ’ পত্রিকার অফিসে গেলেন। অফিসের দোতলায় বড় হলঘরের মধ্যে বিমল কর বসে কিছু লিখছিলেন। তরুণ সরাসরি বিমলবাবুকে গিয়ে বললেন, গল্প এনেছি। তরুণের মুখের দিকে না তাকিয়ে বিমলবাবু বললেন, রেখে যান। -কবে খোঁজ নেবো? -ছ’ মাস পর। ছ’ মাস পরে তরুণ লেখক আবার গেলেন। বিমলবাবু এবার তাকালেন। -কি ব্যাপার? -গল্প দিয়েছিলাম...-কবে? -ছ’ মাস আগে। -কি নাম? নাম শোনার পরে বললেন, দু’  সপ্তাহ পরে খোঁজ নেবেন। দু’ সপ্তাহ পরে খোঁজ নিতে গেলে বলা হল, সাত দিন পরে আসুন। সাত দিন পরে যেতে এবার বলা হল, হ্যাঁ, ছাপা হবে।

তরুণ লেখক তখন বাদল দত্ত লেনে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে একা থাকেন। সেই ঠিকানায় একদিন একটি চিঠি এলো। সঙ্গে একটি খাম। খাম ছিঁড়ে দেখা গেল, গল্পটি ফিরে এসেছে আর ছাপানো চিঠিতে লেখা, গল্প অমনোনীত হয়েছে। বন্ধু সুব্রতকে সব কিছু দেখিয়ে তরুণ রাগে ফেটে পড়লেন, এই হচ্ছে এক নম্বর পত্রিকা! এরা এরকম খেলা খেলে। সুব্রত গালাগাল দেওয়ার পরামর্শ দেয়। বন্ধুর কথা মত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একতলার এক টেলিফোন বুথে ঢুকে পয়সা ফেলে আনন্দবাজার পত্রিকার অফিসে ফোন করে ‘দেশ’ পত্রিকার অফিস চেয়ে নিয়ে চুটিয়ে গালাগাল দিলেন তরুণ। -ছি! ছি! আপনি নাকি এত বড় লেখক! আপনি তো ডাহা মিথ্যেবাদী! বললেন গল্পটা ছাপা হবে। তারপর সেটা ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। সব শুনে বিমলবাবু বললেন,  আপনি কালকেই গল্পটা নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করবেন।

এবার তরুণ ভয় পেলেন। বন্ধুরা সবাই যেতে বারণ করল। ঠিকই তো, ডেকে যদি পুলিশে দিয়ে দেয়। সবাই মিলে ঠিক করল, যাওয়ার দরকার নেই। তারপর বিকেলে মত পালটে সবাই বলল, পুলিশে দিলে দেবে। সবাই মিলে আটকাব। চল যাওয়া যাক।

দলবল নিয়ে, বিমলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন তরুণ। -আপনি গল্পটা আনতে বলেছিলেন...বিমলবাবু পিয়নকে ডেকে বললেন,  তোমাকে তো গল্পটা প্রেসে দিতে বলেছিলাম, তুমি সেটা বাড়িতে পাঠিয়ে দিলে! তারপর তরুণকে বললেন, এত লোক নিয়ে আসার দরকার নেই। বাড়ি যান। সামনের সংখ্যায় আপনার গল্পটি ছাপা হবে। বিমলবাবু কথা রেখেছিলেন। সাল ১৯৬৭। ‘দেশ’ পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যায় সমরেশ মজুমদারের গল্প ‘অন্তর আত্মা’ প্রকাশিত হয়। সেই শুরু। পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত। তিনি এখনও লিখছেন।(ক্রমশঃ)

ছবি : গুগল

3 comments:

  1. খুব ভালো লাগলো ।

    ReplyDelete
  2. এত ছোট্ট একটা লেখা অথচ মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিল ।

    ReplyDelete
  3. খুব ভালো লাগলো ।

    ReplyDelete

সম্পাদকীয়

প্রথমেই প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে শ্রদ্ধা জানাই। করোনাকালীন আবহে তাঁর মতো একজন বিদগ্ধ পণ্ডিত মানুষকে আমরা হারালাম। এখন ...