সাঁঝবাতি ব্লগজিন

Monday, August 31, 2020

সম্পাদকীয়


প্রথমেই প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে শ্রদ্ধা জানাই। করোনাকালীন আবহে তাঁর মতো একজন বিদগ্ধ পণ্ডিত মানুষকে আমরা হারালাম। এখন বড়ো বেদনার দিন। গত মার্চ মাস থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত দেশের এত রত্নের মৃত্যু দেশ বোধহয় আগে কখনো দেখেনি। আমরা তো দেখিই নি। অতএব কেউ ভালো নেই। শুধু চেষ্টা। তবু চেষ্টা। এইভাবেই সবকিছুর মধ্যেও আমরাও সাহিত্য নিয়ে পাগলামি করেই চলেছি। অনেক অক্ষরকর্মীদের ঠাস বুননে এই সংখ্যাটি পাঠককুলে কিছুটা হলেও সমাদৃত হলে ধন্য হবোই। 
সাঁঝবাতি ব্লগজিন দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশ যথেষ্টই আশ্চর্যের। তাছাড়া বিভিন্ন জায়গায় মুদ্রণ বন্ধ থাকায় বহু সম্পাদক বিষণ্ণ। অথচ মুক্তি নেই। ইচ্ছে থাকলেও উড়ান নেই। সাধনা থাকলেও সাধ্য নেই। সম্পাদকীয় বদলে দু কথা লিখলাম আপনাদের পাশে পেয়েই। তবে একটা কথা বলে রাখাই ভালো, এই ব্লগজিনে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার দায় অবশ্যই লেখকের। এই দায় সম্পাদকের নয়। লেখকদের সেই দায়বদ্ধতা নিয়েই সাঁঝবাতি ব্লগজিন সমৃদ্ধ হয়ে উঠুক।  

প্রবন্ধ

রাঢ়ের শৈব ধর্ম : মানব সভ্যতার আদি ধর্ম

উত্তম চক্রবর্ত্তী 

পৃথিবী কৃষ্ণ জলে সমাচ্ছন্ন। সেই অদিকালে এই মহাসমুদ্রের না ছিল নাম, না ছিল পরিচয়। কে দেবে নাম? তখন তো মানুষের আবির্ভাব ঘটে নি। এই সাগরের মাঝে যে ঊষর ভূমি গুলি ছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল রাঢ়। রাঢ় দেশ। কালের গতি এগিয়ে চলল। ঝড় বৃষ্টি তে রাঢ়ের ভূমি ক্ষয় হতে হতে পর্বত গুলির উচ্চতা কমতে লাগল।অবক্ষয়ে পর্বত গুলির মাথায় সঞ্চিত বরফ ঝরে পড়ল। রাঢ়ের নদী গুলি পূর্ব বা দক্ষিণ -পূর্বে বহে যাওয়ার সময় ক্ষয়জাত পালি বালি পূর্ব রাঢ়ে সঞ্চয় করে তরঙ্গায়িত ভূমির সৃষ্টি করে। কালের প্রবাহ পথে আজ থেকে প্রায় দশ লক্ষ বছর আগে মানুষের আবির্ভাব ঘটে। মানুষ রাঢ়ের বন জঙ্গলে বসবাস করতে থাকে। খাদ্যের চাহিদা তারা ক্রমশ পশ্চিম রাঢ় থেকে পূর্ব রাঢ়ের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। 

রাঢ় বলতে পশ্চিম রাঢ় যাহা সাঁওতাল পরগনা,, বীরভূম, পশ্চিম বর্ধমান, ইন্দাস থানা বাদে বাঁকুড়া জেলা, মানভূম, রাঁচী জেলার সিল্লি, সোনাহাতু, বুন্ডু-তামাড়, সিংভূম জেলা এবং মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমাংশ।

পূর্ব রাঢ়ের মধ্যে পশ্চিম মুর্শিদাবাদ, বীরভূমের উত্তরাংশ, পূর্ব বর্ধমান, হুগলি, হাওড়া, পূর্ব মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া জেলার ইন্দাস থানা। মোটামুটি এই ছিল রাঢ় ভূমি। 

রাঢ় অঞ্চলের মানুষ পশুচারণ শিখল, চাষবাস শিখল। ধীর গতিতে এগিয়ে চলল সভ্যতা। রাঢ়ের ফাগুন মাসের আগুন ঝরা রূপ। মানুষের রক্তে নাচন ধরায়। সে আজ অনেক বছর আগের কথা। তারা নিশ্চয় তপস্যা করেছিল। কে তাদের তপস্যা শিখিয়েছিল? 

তাদের অন্তরের প্রাণপুরুষ তপস্যা শিখিয়েছেন, তিনি হলেন সদাশিব। ভারতে তখন আর্যরা আসতে শুরু করেছে, এমন সময় রাঢ়ে জন্মেছিলেন রাঢ়ের প্রাণপুরুষ সদাশিব। তাঁরই জিয়ন কাঠিতে মানুষ সভ্যতার ধারাতে মিলিত হল। 

আজ থেকে প্রায় সাড়ে সাত হাজার বছর আগে সদাশিবের আবির্ভাব ঘটে। এই বিরাট মহাপুরুষ মানব জাতির কল্যাণে উদার শৈব ধর্ম প্রবর্তন করেন, রাঢ় সেই শৈব ধর্মকে সর্বতোভাবে তার প্রাণীন সম্পদে পরিনত করে। অন্যরা রাঢ়ে আসার আগে থেকেই দীর্ঘদিন ধরে রাখে চলেছিল উদার শৈব ধর্ম। 

রাঢ়ে তথাকথিত নিম্নবর্ণে শৈব মতে বিবাহ এখনও প্রচলিত আছে। বর-বধূর মালা বদল হলে, বর কনেকে কিছু ধান দেয়। ধান দেওয়ার অর্থ - আমি কনের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিলাম। এর পর বর কনের মাথায় কিছু সিঁদুর ঢেলে দিল। এই ভাবে সহজ সরল অনাড়ম্বর পরিবেশে কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিবাহ সম্পন্ন হয়ে পড়ে। 

এই হল উদার শৈব মতবাদের অন্যতম নিদর্শন। 

সদাশিব মূর্তি পূজা সমর্থন করতেন-- এর কোন প্রমাণ নেই। কিন্তু শিবের তিরোভাবের পর সমাজে দেখা দিল এক বিশেষ ধরনের পূজা পদ্ধতি - লিঙ্গ পূজা। এই লিঙ্গ পূজার মধ্যে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক প্রয়োজনে একটা সুন্দর বিমিশ্রণ ছিল। গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে তখন চলত পরিচ্ছেদহীন সংগ্রাম। সকল গোষ্ঠীই নিজেদের সংখ্যা বাড়াতে চাইত। তাই সংখ্যা বৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে তারা প্রথম লিঙ্গ পূজার প্রবর্তন করেছিল। 

পরবর্তী কালে এই লিঙ্গ পূজাকে আধ্যাত্মিকতায় উদ্বুদ্ধ করা হয়। সে যুগের মানুষের ধ্যান ধারনা ছিল সহজ সরল, কিছুটা স্থূলও ।তাই তারা পুরুষ প্রকৃতির ভাবটা নিয়ে  (শিব-শক্ত্যাত্মকং ব্রহ্ম) তারা লিঙ্গপূজার প্রচলন শুরু করছিল। এই লিঙ্গপূজাই পৃথিবীর আদিমতম পূজা পদ্ধতি। সমাজতত্ত্ববিদরা  এটাকে ধর্মের পথে প্রথম পদক্ষেপ বলে মনে করেন। 

রাঢ়ের বহুস্থানে এ ধরনের অজস্র শিবলিঙ্গ ছড়িয়ে রয়েছে। প্রায় প্রতিটি গ্রামেই যে শিব মন্দির দেখতে পাওয়া যায় তাদের অনেক গুলি আড়াই থেকে সাত হাজার বছর পুরানো। এদের মধ্যে বাঁকুড়া জেলার এক্তেশ্বর ,পুরুলিয়ার বুধপুরের বুদ্ধেশ্বর,টুশ্যামার বাবা আদিনাথ, মানবাজারের নিকট বড্ডি গ্রামের পরেশনাথ, যা কংসাবতী জলাধার নির্মানের সময় কংসাবতী পাড়ের উপর স্থাপিত করা হয়, পায়রাচালী গ্রামের ভগড়ার বুঢ়া বাবা, হুগলির তারকেশ্বর প্রভৃতি লিঙ্গের নাম উল্লেখ করা যায়। 

আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে রাঢ়ে জৈন ধর্ম ও বুদ্ধ ধর্মের বিকাশ ঘটলেও, সাড়ে ছ'শো খ্রীষ্টাব্দে রাঢ়ের স্বাধীন শৈব রাজা শশাঙ্ক বহু জৈন ও বুদ্ধ মূর্তি ভেঙে পুনরায় শৈব ধর্মকে তার নিজের আসন ফিরিয়ে দেন। আজও রাঢ়ের ব্রতকথায় ঘুরে ফিরে কেবলই শিবের মাহাত্ম্য প্রচারিত। রাঢ়ের চড়ক, গাজন, ও বোলান উৎসব সম্পূর্ণত শিবকেন্দ্রিক।

তথ্যসূত্র - সভ্যতার আদি বিন্দু রাঢ়।

ছবি : দয়াময় রায় 

ধারাবাহিক

নাটক থেকে লেখক

অরূপম মাইতি

কলকাতার স্কটিশ কলেজের পড়ুয়া এক দল ছেলে ঠিক করল, নাটক করবে। নাটক লেখার দায়িত্ব দেওয়া হল দলের এক সদস্যকে। পড়তে গিয়ে দেখা গেল, নাটক হয়নি। দলের একটি ছেলে, নাম সুব্রত পরামর্শ দিল,  আগে গল্প লিখে, তাতে নাট্যরূপ দিলে ঠিক হবে। যেমন কথা তেমন কাজ। তরুণ লেখক রাত জেগে গল্প লিখলেন। তারপর তাকে নাট্যরূপ দিলেন। দলের সবাই বলল,  গল্প তো হয়েছে, তবে এ নাটক করা যাবে না। 

পরপর দু-বার উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ ছেলেটিকে চাঙ্গা করতে আবার ত্রাতার ভূমিকা নেয় সুব্রত। পরামর্শ দেয়,  গল্পটি কোন পত্রিকায় দিলে নিশ্চয় ছাপা হবে। তরুণ লেখক স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। কোন পত্রিকায় দেবে, ঠিক করতে গিয়ে খানিক ধন্দেও পড়ে। নিজেই সিদ্ধান্ত নেয়,  পয়লা নম্বর পত্রিকাতেই সে লেখাটি পাঠাবে। 

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের কোনও লেখাতে সে পড়েছিল, ‘শুরু করা উচিত চূড়া থেকে...’। চূড়া বলতে তখন ‘দেশ’ পত্রিকা! তবে সেখানে তাবড় তাবড় লেখকেদের ভিড়। কে না আছে!  বিমল মিত্র থেকে তারাশঙ্কর, তাদের সাথে বিমল কর এবং তাঁর বিখ্যাত দশজন শিষ্য,  রতন ভট্টাচার্য শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। শিষ্যদের নিয়ে বিমল কর হামেশা হয় বসন্ত কেবিন নয় কলেজ স্ট্রীটে বসতেন। পরে এঁদের আড্ডা উঠে এসেছিল কার্জন পার্কে।

তরুণ লেখক একদিন ‘দেশ’ পত্রিকার অফিসে গেলেন। অফিসের দোতলায় বড় হলঘরের মধ্যে বিমল কর বসে কিছু লিখছিলেন। তরুণ সরাসরি বিমলবাবুকে গিয়ে বললেন, গল্প এনেছি। তরুণের মুখের দিকে না তাকিয়ে বিমলবাবু বললেন, রেখে যান। -কবে খোঁজ নেবো? -ছ’ মাস পর। ছ’ মাস পরে তরুণ লেখক আবার গেলেন। বিমলবাবু এবার তাকালেন। -কি ব্যাপার? -গল্প দিয়েছিলাম...-কবে? -ছ’ মাস আগে। -কি নাম? নাম শোনার পরে বললেন, দু’  সপ্তাহ পরে খোঁজ নেবেন। দু’ সপ্তাহ পরে খোঁজ নিতে গেলে বলা হল, সাত দিন পরে আসুন। সাত দিন পরে যেতে এবার বলা হল, হ্যাঁ, ছাপা হবে।

তরুণ লেখক তখন বাদল দত্ত লেনে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে একা থাকেন। সেই ঠিকানায় একদিন একটি চিঠি এলো। সঙ্গে একটি খাম। খাম ছিঁড়ে দেখা গেল, গল্পটি ফিরে এসেছে আর ছাপানো চিঠিতে লেখা, গল্প অমনোনীত হয়েছে। বন্ধু সুব্রতকে সব কিছু দেখিয়ে তরুণ রাগে ফেটে পড়লেন, এই হচ্ছে এক নম্বর পত্রিকা! এরা এরকম খেলা খেলে। সুব্রত গালাগাল দেওয়ার পরামর্শ দেয়। বন্ধুর কথা মত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একতলার এক টেলিফোন বুথে ঢুকে পয়সা ফেলে আনন্দবাজার পত্রিকার অফিসে ফোন করে ‘দেশ’ পত্রিকার অফিস চেয়ে নিয়ে চুটিয়ে গালাগাল দিলেন তরুণ। -ছি! ছি! আপনি নাকি এত বড় লেখক! আপনি তো ডাহা মিথ্যেবাদী! বললেন গল্পটা ছাপা হবে। তারপর সেটা ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। সব শুনে বিমলবাবু বললেন,  আপনি কালকেই গল্পটা নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করবেন।

এবার তরুণ ভয় পেলেন। বন্ধুরা সবাই যেতে বারণ করল। ঠিকই তো, ডেকে যদি পুলিশে দিয়ে দেয়। সবাই মিলে ঠিক করল, যাওয়ার দরকার নেই। তারপর বিকেলে মত পালটে সবাই বলল, পুলিশে দিলে দেবে। সবাই মিলে আটকাব। চল যাওয়া যাক।

দলবল নিয়ে, বিমলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন তরুণ। -আপনি গল্পটা আনতে বলেছিলেন...বিমলবাবু পিয়নকে ডেকে বললেন,  তোমাকে তো গল্পটা প্রেসে দিতে বলেছিলাম, তুমি সেটা বাড়িতে পাঠিয়ে দিলে! তারপর তরুণকে বললেন, এত লোক নিয়ে আসার দরকার নেই। বাড়ি যান। সামনের সংখ্যায় আপনার গল্পটি ছাপা হবে। বিমলবাবু কথা রেখেছিলেন। সাল ১৯৬৭। ‘দেশ’ পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যায় সমরেশ মজুমদারের গল্প ‘অন্তর আত্মা’ প্রকাশিত হয়। সেই শুরু। পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত। তিনি এখনও লিখছেন।(ক্রমশঃ)

ছবি : গুগল

গল্প

ডর

তরুণ পাত্র

সৃঞ্জয় আজ ভীষণ খুশি। জীবনে এতো খুশি আর কখনো হয়েছে বলে মনে পড়ে না। তার বহুদিনের স্বপ্ন তার নিজের একটা বাইক হবে, সেই বাইকের পিছনে থাকবে ঝিমলি, মুকুটমণিপুরের ড‍্যাম পাড় দিয়ে বাইক ছুটবে।ঝিমলির পশম পারা চুল উড়বে বাতাসে। পরেশনাথের ওখানে গিয়ে ঝিমলির চুলে গুঁজে দেবে রাঙা পলাশ; তখন ঝিমলির সারা মুখ রাঙা হয়ে উঠবে। অস্তমিত সূর্যের সাক্ষাতে ওর দুটো হাত ধরে সৃঞ্জয় বলবে "ঝিমলি আমি তোকেই ভালোবাসি--শুধু তোকে।" 

তাই শোরুম থেকে বাইকটা নিয়েই রওনা দিয়েছে মোলডুংরির দিকে। ওখানে বাঁশনালার রাস্তার ধারে অপেক্ষা করবে ঝিমলি। মাকে বলেই বেরিয়েছে বাইক নিয়ে সোজা যাবে অম্বিকানগর, মা অম্বিকার পুজো দিয়ে বাড়ি নিয়ে আসবে। তাই অনেকটা সময় আজ ঝিমলির সাথে কাটানো যাবে।

ওদিকে ঝিমলিও কলেজ যাবার নাম করে বেরোবে।ওর হাতেও অনেক সময়, আজ শুধুই আনন্দ। আনন্দের লহর উঠেছে সৃঞ্জয়ের মনে।

ঝিমলি আজ সকাল থেকে কিছু খায় নি, মা অম্বিকার পুজো দেবে যে। মা কে বলে দিয়েছে এক বান্ধবীর জন্মদিন, সে সবাইকে ঐশীতে খাওয়াবে। সকাল স্নান করে তৈরি হয় ঝিমলি। আজ সেই আগুন রঙের কুর্তিটা পরেছে সে। সৃঞ্জয়ের পচন্দের রঙ এটা। সে বলে এটা পরলে না কি তাকে পরীর মতো দেখায়। সাইকেল নিয়ে যেতে হবে খানিকটা, তারপর পানমনিদের বাড়িতে সাইকেল রেখে সৃঞ্জয়ের সাথে।

সৃঞ্জয় সার্কাস ময়দান পেরিয়ে যখন আমডাংরা স্কুলের কাছে পৌঁছলো দেখে সেখানে প্রচুর লোক। কী হয়েছে জানতে বাইকটা দাঁড় করিয়ে একটু এগিয়ে যেতেই একজন বাধা দিয়ে রললো "তুই যা ক‍্যানে ,ইসব আমদের সমাজের ব‍্যাপার, তরা দিকু তদের ইসবে না থাকাই ভালঅ।

কী হয়েছে? জিগ‍্যেস করে সৃঞ্জয়।

লোকটি বলে দ‍্যাখনা ক‍্যানে আমদে ঘরের মাইয়া গুলা সস্তা বঠে? উ বাবুট হপনের বিধবার কাছে দিনঅই আইসত আইজ ধইরেছে।

সৃঞ্জয় তাকিয়ে দেখে দুজন মাঝবয়সী নারী পুরুষকে হাত বেঁধে গাছে ঝোলানো আছে,আর গোটাকয় লোক মোটা লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। বাকিরা মজা দেখছে।ওরা বেঁচে আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না।

 সারা শরীর দিয়ে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে যায় সৃঞ্জয়ের... ঝিমলি ও যে এদেরই মেয়ে!

অলঙ্করণ : সংগ্রাম শীল 

গল্প

দায়

তাপস পাত্র 

"মানলাম স্যারকে তুই শ্রদ্ধা করিস। উনি তোকে স্নেহও করেন। তোকে এ ব্যাপারে ঠাট্টাও করেছি। তাই বলে কী বলছিস তুই এটা?" শান্তম রীতিমতো উত্তেজিত।

"না বলার কী আছে? তোর অসুবিধেটা কোথায়?" খর চোখে শান্তমকে জরিপ করল নৈঋতা।

"আমার অসুবিধের কথা কেন বলছিস। অসুবিধেটা তো তোর।"

"হাস্যকর কথাবার্তা। এতে আমাদের দুজনেরই সুবিধে।" নৈঋতাকে যেন মজায় পেয়েছে," তুই কবে কাজ পাবি আদৌ পাবি কিনা গ্যারান্টি আছে? পিএইচডির স্কলারশিপ আর তিনটে বছর। তারপর? সে যাই হোক, একটা রুচিশীল ভদ্র সুশিক্ষিত বুড়োমানুষ। প্রাক্তন অধ্যাপক। একা থাকেন। অর্থ বিত্ত বাড়ি গাড়ি কিছুরই তো অভাব নেই। ওর কিছু মনোযোগ, যত্ন, সান্নিধ্য দরকার। বিনিময়ে আর সব কিছু আমার। একটা সহজ ডিলিংস। কী বলিস?" শেষ অংশটা কি বড়ো বেশি বলা হয়ে গেল? ভাবল নৈঋতা।

"পৃথিবীতে কতোজনার কতোকিছুই দরকার। তুই পূরণ করতে পারবি?" শান্তমের তখনো মেনে নেওয়ার লক্ষণ নেই।

"আমাকেই বা সবার সব কিছু  পূরণ করতে হবে কেন? আমি যতোটুকু পারি যা পারি।" বলল নৈঋতা।

"তাই বলে একটা সত্তর বছরের বুড়োকে তুই বিয়ে করবি? সে তো কিছুদিনেই টেঁসে যাবে তখন কী করবি তুই?"

"তখন তুই আমি বিয়ে করে নেব।" মৃদু হেসে বলল নৈঋতা।

"লোকটা কবে মরবে তার ঠিক আছে? অতোদিন অপেক্ষা করতে পারব না।"

"কিসের অপেক্ষা শান্তম? তুই আমাকে কতোবার আদর করেছিস। কতোবার একসাথে বেড়াতে গিয়ে বাইরে থেকেছি। তোর কিসে আটকেছে? তোর ভাড়া ঘরে কতোদিন রেঁধে খাইয়েছি তোকে। কতোদিন থেকে গেছি। এর পরেও কিসে আটকাবে? তোর মা তো এখুনি আমাদের বিয়েতে এমনিতেই রাজি নন। মনে কর না আমাদের বিয়ের আগে এটা পার্ট টাইম জব।" এতোটা বলে প্রথম শ্বাস নিল নৈঋতা। তার গলায় বিদ্রূপ স্পষ্ট। 

"বাজে বকিস নি তো।" শান্তম রীতিমতো  বিরক্ত।

"তোকে আমি বিয়ে করতে পারব না শান্তম।" নৈঋতার গলায় তীব্র ভাঙন।

বিস্মিত শান্তম হতভম্বের মতো তাকালো নৈঋতার দিকে।

 "তুই তো আমার কথা শুনে বলতেই পারতিস স্যারকে আমরা আমাদের সঙ্গে রাখব।  আমাকে হারানোর কথা ভেবেও সে সমাধান একবারও তোর মনে এল না? এতটুকু উদার হতে চাইলি না তুই?"

 নৈঋতার গলার কাঠিন্য স্তম্ভিত করে দিল শান্তমকে।

অলঙ্করণ : কুমারেশ দাস 

গল্প

অক্সিজেন  

সন্দীপ সেনগুপ্ত

বাসটা সেদিন হঠাৎ করে প্রচণ্ড জোরে ব্রেক মেরে দাঁড়িয়ে গেছিল। ড্রাইভারের পাশে বসে থাকায় ঝাঁকুনিটা সামলে নিতে পেরেছিল অমিত। কিন্তু পেছনে বসে থাকা লোকগুলোর কেউ কেউ ছিটকে লাফিয়ে উঠেছিল। কারো মাথা ঠুকে গেছিল  সিটের পেছনে।

-কিরে ভাই মারবি নাকি?

-গাড়ি চালাতে জানিস না?

-নতুন ড্রাইভার নাকি? এদের যে কে লাইসেন্স দেয়?

- এইসব শালাকে না মারলে কিছুই শিখবে না দাদা।

-ঠিক বলেছেন এরা ভদ্রলোকের ভাষা বোঝে না।

হাওয়া ক্রমশ গরম হচ্ছিল।

ঠিক এমন সময় বাসের সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত পায়ে উঠে এসেছিল মেয়েটা। ব্ল্যাক জিন্সের ওপরের টপটা উপস্থিত জনতার দৃষ্টিকে যেন আহবান করছিল।উঠে এসেই বক্ষবিভাজিকা ঘেঁষে সানগ্লাসটা গুছিয়ে রাখতে রাখতে দ্রুত খুঁজে নিয়েছিল একটা ফাঁকা সীট। সেদিকে তাকিয়ে সেই গরম হাওয়া অনেকটাই ঠাণ্ডা হয়ে গেছিল।

একবার আড়চোখে দেখে নিয়ে অমিত আওয়াজ দিয়েছিল- ‘অক্সিজেন ! অক্সিজেন!’

আসলে জুন মাসের সেই বিকেলটা এতই গরম ছিল যে ড্রাইভার ছেলেটা বারবার ঘ্যান ঘ্যান করছিল- আজকে বীভৎস গরম। ইঞ্জিনের গরমে আরও দম বন্ধ হয়ে আসছে মনে হচ্ছে। একটুও হাওয়া পাওয়া যাচ্ছে না। বৃষ্টি না হলে আর পারছি না।

-আরে ভাই তুই তো তোর অক্সিজেনের জন্য আমাদের মেরেই ফেলবি মনে হচ্ছে।

মুচকি হেসে আবার স্পীড তুলেছিল ছেলেটা। 

মেয়েটা তখন গুছিয়ে বসে লিপস্টিকটা ঠিক করে নিল। একবার দেখে নিল আইলাইনারটা ঠিকঠাক আছে কিনা। যেন এতক্ষণ কোন কথাই ওর কানে  ঢোকেনি।  

যতক্ষণ বাসে ছিল ততক্ষণ অনেকের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল সে।অমিতও বেশ কয়েকবার মেপে নিয়েছিল তাকে। তারপরে বোধ হয় মিন্টো পার্কের ওদিকটায় মেয়েটা নেমে গেছিল। 

সেই বিকেলটার কথা প্রায় ভুলেই গেছিল অমিত। আজকে হঠাৎ হাসপাতালের একত্রিশ নম্বর বেডে একটা আবার একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সেই বিকেলটা ফিরে এল। করোনার প্রকোপে প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টে যখন হাঁপাচ্ছিল সে ঠিক তখনই অক্সিজেন মাস্কটা ব্যস্ত হাতে লাগিয়ে দিচ্ছিল যে মেয়েটা, পিপিই পরা থাকলেও আড়ালে থাকা সেই মুখটাকে অমিত ঠিকই চিনতে পেরেছিল।

অলঙ্করণ : চণ্ডীদাস সামন্ত

কবিতা


দিলীপ মহান্তীর গুচ্ছ কবিতা 

বসন্তের গান

দিনগুলি ঝরে বৃন্তের ডগা থেকে

ওই দেখো দূরে কৃষ্ণচূড়ার সারি

একদিন যার হাওয়া লেগেছিল গায়ে

পথ মাখে শুধু রক্তিম পদধূলি;


পাতা উড়ে আসে জলের গন্ধ মেখে

নদীদের পাড়া আকাশের কোন পারে

তীরগুলি ভাঙে স্রোতের তীব্র ঘায়ে

বালিদের বুকে ফাল্গুন জমে আছে।


রাধা

কখনো কখনো আগ্নেয়গিরি জাগে

নির্গত হয় গলিত লাভার স্রোত

মনে করো সে সব প্রহর জেগে

লিখছি কবিতা বৃষ্টি আনার ভোর;


তুমি এনে দেবে আমার আষাঢ় মাস

তুমি এনে দেবে যক্ষের আকুলতা

স্বপ্নে ভাসবে দূরের অলকাপুরী

দুয়ারে দাঁড়াবে বৃন্দাবনের রাধা।


পথের গান

যে রঙিন সাঁকো একা পড়ে আছে

তলদেশে জলরেখা,

তার দুই তীরে ক্ষোভ জমে আছে

নিষিদ্ধ পথরেখা!


যে উঠোনে একা রোদ নেমে আসে

ভেতরে অন্ধকার,

তার বিরুদ্ধ দেয়ালের গায়ে

হাওয়ারা নিরুত্তর!


রাত্রির গান

নীল একপাতা উড়ে উড়ে যায়, এ সময় নির্জন

বহু দূর থেকে গড়িয়ে পড়েছে গভীর রাতের ঘ্রাণ!


আকাশ এসেছে নেমে রাস্তায়, সন্ধ্যাতারাও একা

জনহীন দিঘি মন্দিরে তালা নদীর সঙ্গে দেখা!


বাতাসের মৃদু বিশ্বাস দোলে রজনীগন্ধা বনে

রাতজাগা পাখি রক্ত চক্ষু দীর্ঘ প্রহর গোনে!


কত প্রতীক্ষা আকাশের মেঘে নীল রাত্রির টানে

ভাসাক পৃথিবী মৃত্যু আসুক তীব্র স্রোতের গানে।


কাঁটাতার

চারদিকে কত বিষাক্ত হাওয়া বারুদ উড়ছে মেঘে

পাতাগুলি হলুদ হয়েছে অস্থির দিন মেখে!


কান পেতে শোনো সাইরেন বাজে সীমান্ত নির্বিকার

হিংসার ধ্বনি রোদে ঝরে পড়ে ঝলসায় কাঁটাতার!


এরই মাঝে দেখো তুমি বসে আছো আকাশ ভাসছে চোখে

রূপকথাগুলি হারিয়ে গিয়েছে প্রবল শীতের রাতে!


টিভির পর্দা ভেসে উঠে মনে যুদ্ধের রণসাজ

চিরকাল বুঝি আঁধারে ভাসছে পিছনের পরিবার!


ঝর্ণা

ঝর্ণার জল পাথরের কাছে এসে

দিতে চেয়ে ছিল তার গোপন কথা


সময় শুধু নির্বাক চেয়েছিল

হাওয়ায় হাওয়ায় দীর্ঘশ্বাস কাঁপা


প্রতীক্ষা আর অনাদর চোখে বেঁধে

নৈঋত কোণে ঘন কালো মেঘ জমা


অকাল বর্ষা ভাসিয়েছে মাঠ ঘাট

নদী চলে গেছে সাগরের কাছে একা।


রাত্রির চিঠি: ১

পাহাড়ের চোখ সমতলে ঘোরে নদীরেখা দূরে সরে

বহু সময়ের লোভ অপচয় ঘাসের শিশিরে ঝরে...


ঘুমহীন চোখ দূরের আকাশে কোন তারা খুঁজে যায়

ক্লান্ত সকাল হাওয়ায় হাওয়ায় না পাওয়া চিঠি পাঠায়!


দিবসের তাপে ফুল ঝরে যায় ভাষা থামে ঠিকানায়

দগ্ধরাত্রি কেঁপে কেঁপে ওঠে নিষিদ্ধ এক কামনায়!


রাতজাগা নদী তরোয়াল খোলে দিগন্ত পাহারায়

সাগরের ঢেউ নোনা হাওয়া এনে সৈকত সামলায়।


রাত্রির চিঠি: ২

শীতকাল জুড়ে শুষ্করাত্রি শিশির পড়েছে ঝরে

তীব্র ব‍্যথায় ক্লান্ত চোখেতে চাঁদ ডুবে যায় ঘাসে;


তুমি বিছানায় নীরবে ঘুমোও রোদের ইশারা মেখে

মনেও পড়েনা নদীস্রোতে কার গোপন স্পর্শ  ভাসে...


ঝরে পড়া ফুল মাটির ওপর নিশ্বাসখানি কাঁপে

হাওয়ায় হাওয়ায় নীরব রাত্রি বয় সকালের ঘাটে;


দিগন্ত থেকে মিছিল চলেছে তারার আসা যাওয়া

আকাশব‍্যাপী দীর্ঘ বর্ষা মেঘেরা লিখেছে মায়া।


দুঃসময় 

দু'চোখ ভরে অরণ্যের স্বাদ

পায়ের পাতায় সমুদ্রের নুন

আমরা দেখেছি পাহাড়ের গাঢ় রং

হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে যায় ফাল্গুন...


বুনে যাওয়া সেই মাকড়সার জাল

এককোণে বসে শিকারের সন্ধান

প্রতিবেশীদের চোখে নেমে আসে রাত

আমরা দিয়েছি অনেকের ঘরে ত্রাণ।


রাজপথ দিয়ে জন্তুরা হেঁটে যায়

খিদেয় বাতাস হিংস্র অজগর

চারদিকে কত প্রজাপতি ডানা মেলে

ফাঁকা প্রান্তরে রজনীগন্ধা ফোটে।


দিনগুলি ছুটে ক্লান্ত মিছিল ধরে

আকাশের দিকে মরা মানুষের হাত

ধুলো ওড়া পথে অকাল সন্ধ্যা নামে

রাত্রিও চায় শুধু একমুঠো ভাত।


অনুশোচনা

তুমি ডুবে যাও ঘোলা জল ঘেরা অনুশোচনার খালে,

অপেক্ষার তপ্ত আগুনে সেঁকে নাও  দুটি হাত

পৃথিবীর আরো ঝলসানো রূপ

পুরে নাও ক্ষোভে, রিক্ত দু'চোখ মেলে...


চারপাশে কত রোদ নিয়ে আছি

হাওয়াকে জড়িয়ে রেখে

সরে গেছে দীর্ঘ ধুলোর ঝড়

সাগরের করতলে;


নীল জল মাখে মরুভূমি মেঘ

আকাশে বাজনা বাজে

তুমি বসে থাকো ক‍্যাকটাস বনে 

শীতকে জড়িয়ে রেখে।


মধ‍্যরাত্রির কথকতা

মধ‍্যরাত্রি সংকেতে কাঁপে কতদূরে নদীজল

দীর্ঘ প্রহর জেগে রয় একা অমাবস্যার ক্ষণ

দু'পাশের বালি টেনে নেয় ঘূর্ণায়মান স্রোত

দেরি হয়ে গেছে পথ দুর্গম ঠিকানা অন্তহীন।


জেগে থাকা রাত,আরো নির্জন, দগ্ধ হাওয়ায় কাছে

নিশাচর তারা চুপি চুপি যায় রজনীগন্ধা বনে

কত কত মাঠ রিক্ত হৃদয়ে লিখে রাখে অভিমান

তারায় তারায় মহাকাশ জুড়ে ক্রমে প্রকাশকাল।


নদী হয় বড়,রাত্রিরা ক্ষীণ, রুগ্ন ভোরবেলায়

হাওয়া ছুটে আসে নীরবতা ভেঙ্গে ক্লান্ত মেঘের দল

অস্ফুট আলো হেসে হেসে পড়ে পাতাদের স্বরলিপি

পাখি উড়ে গেছে আকাশের বুকে ডানাদের করতালি।


দেশের বাড়ি

সব রাস্তায় আলপনা আঁকা মুখ

দরজায় ঝোলে আমন্ত্রণের লিপি

বাড়ি গুলো যেন কথা বলে ওঠে হেসে

জ‍্যোৎস্নায় ধোয়া উঠোন ডাকছে কাছে।


পথে খেলা করে ধুলোমাখা  কিছু ছেলে

কিছু ছেলে গেছে জঙ্গলমাখা রোদে--

মানুষের চোখে আর্তনাদের ছবি

বিশ্বাস শুধু গাছের ডালে ভাসে!


আ়ঁধার রাত্রি নীরবে বইছে জলে

তারাদের মুখে ব‍্যাকুল গানের কলি

ঘরছাড়া হাওয়া লুকোয় সবুজ ভিড়ে

পথে পথে কত ঝুমুর গান ওড়ে।

অভিনিবেশ  

মনোজ বাগ 

কত খানা খন্দ অলিগলি তস্য গলি হয়ে চলেছি ...

একটা সোজা রাস্তা, জন্ম জীবন মৃত্যু 

তবু  তাতেও কত ঘুরপাক! 


দেখছি একটি একটি মানুষ, 

একটি একটি মানুষের গতি - প্রকৃতি 

দেখছি, একটি একটি রাস্তা, 


কত সহজ সরল মানুষ।

কত জটপাকানো রাস্তা।


দেখেছি রাস্তা স্বল্প দৈঘ্যের হলে সে অন্য কথা, 

কিন্তু  যে রাস্তা সুদীর্ঘ তাতে আছে অনেক অনেক বাঁক , উঁচুনিচু  

আছে অনেক অনেক পথশ্রান্তি ,


দেখেছি , মুহূর্তের দেখায় যা সহজ সরল মনে হয়।

দীর্ঘ সময় থাকতে থাকতে  তারও কাঠিন্য চোখে পড়ে  


চলা যত দীর্ঘ হয়, দেখা শোনার বোঝার এই সঞ্চয় 

ততই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।

তারপর কোন একদিন মনে হয় দূর্ আর না -

ঝোলাঝুলি সব খালি করে  

গিয়ে দাঁড়াই চারদিক খোলা কোন সমুদ্র সৈকতে


এক সমুদ্র জলের নীল আর

এক আকাশ শূন্য 

যে  ক্ষীণ একটি  রেখায় মিশে আছে 

তার দিকে অপলক হয়ে  চেয়ে থাকি।


আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে অনেক মানুষ পশুপাখি, লাল কাঁকড়া, তারামাছ, জেলি 

বালিতে পড়ে থাকা কত হাজারো রকমের ঝিনুক ...


সারা দিনের শেষে তবুও খুবই সামান্য মনে হয় এই দেখা।

গোধুলির আকাশ যখন কিছুটা লালাভ।

সিঁদুর রঙের ডুবন্ত সূর্য আমাকে শিক্ষা দেয়-


যে কোন অভিনিবেশই একটু আধটু নয় 

সমগ্র জীবন দাবি করে।

যেমন শিল্প সাহিত্য যেমন প্রিয়জন 

সবাই সব্বাই।

 

আমি  স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকি ...

বিশ্রামাগার

শুভায়ু দে

চার দেওয়ালের একটা ঘর,মাঝে একটা বিশ্রামঠেক।

যাদের ঘর নেই,আকাশ টাকে চৌকো হিসাবে ধরতে পারে।

চার কোণা স্কাই কালারের ভারচুয়াল দেওয়াল।

ফ্লোরে শূন্যতা নামক ফুটপাত অথবা জলপ্রদেশ।

নৌকার ছইয়ের দেওয়ালের মাঝে একটা মাঝি বসে।

তার পিঠেও রাত্রি নামে,স্পন্ডেলাইটিস এর ব্যথায়।

নক্ষত্র সারারাত খালি পিঠে ট্যাটু বানায়।

জলের রাজার পিঠ।

চুল্লির মালিককেও মাঝি বলা যেতে পারে।

শ্মশানের শয়নকক্ষের কোনো বেওয়ারিশ লাশকে,

অগ্নিসংযোগে অন্য মহাদেশে পাঠিয়ে দেয়।

রাত হলেই শুতে হবে তার মানে নেই।

ওরা যখন ঘুমিয়ে পড়ে,সেটাই একেকটা রাত।

একেকটি খাটের পা ধরে পড়ে থাকে নাছোড়বান্দা রাত।

নিজের আইসোলেশনে ঠুমকা ঠুমকা হেঁটেছি

অভিজিৎ দাসকর্মকার 

চিত্রকলার নিচে শব্দের ঠিকানা, আর 

চিরদিনের ধ্রুবতারা ঘুলঘুলিতে অন্ধকার অন্ধকার চুপি দেয়। 


 সমকোণ সূচিত করো, যদিও টেঁড়া মেড়া কপাল লেখা

 সিঁদুরের কৌট আনো বলে করমর্দন করছে ইয়াল্লা শুকু শুকু


শরীর দিয়ে চলে যায় নিখিলবঙ্গের টসটসে বৃষ্টি। 

জেরবার হচ্ছো?

আমিও তো বুঁদ গ্লাসের নেশায় কাৎরা কাৎরা ডুবেছি। রাস্তার লজিক্যাল ক্র্যাকে জাঁকিয়ে বসে দুঃখের সমীকরণ চিবোতে চিবোতে, আবার 

নিজের আইসোলেশনে ঠুমকা ঠুমকা হেঁটেছি


আচ্ছা গন্তব্যের যে পাণ্ডুলিপিটা পাশের দেহে নির্যাস হয়ে একে একে একটা দুপুরের একদিকে অসন্তুষ্ট হচ্ছে

তার থ্যাঁৎলানো চামড়ার গভীরে ওভারডোজের আরাম রুয়েছে যাপনের কৌশল ———

বাদ দাও। এখন ৩:৪০-এর বিকেল।

টেবিলক্লথটায় বিচ্ছিন্ন সময়ের যে অনুলিপি এনেছি তাতে ১৪ আগস্টের তারিখ সহ পাতো--


আরে মেচেন্টা রঙের ব্লাউজ পরো। দ্যাখো চোখের ভিতর মৌন মিছিলে আমি নিদারুণ নিঃসঙ্গ, 

টিভি খোলা। চূড়ান্ত কবিতারা বিষমবাহু ত্রিভুজ এবং সাদা সোমবার পালন করছে

যম

সুজিত রেজ 

হে নচি, আমার বাহুবন্ধন খুলেছি  

তোমার মুষ্টি বাড়াও। আজানুলম্বিত বাহুমূল  

চেপে ধরো বৈদ্যুতিক ক্ষিপ্রতায়  

নচিকেতাতালের এ পার ও পার জুড়ে 


মৃত্যুর ও পারে কোন স্টেশন অপেক্ষমাণ  

সে প্রশ্ন এখন যাদুঘরে 

আমার কৌতূহল স্বতন্ত্র  

আর কতদিন এই খাণ্ডবদাহন 

সন্ত্রাস-লাশের উৎকট প্রদর্শনী  

এত কেন ক্ষুৎকাতর তুমি  

হে নরকশ্রী , কী চাও তুমি হে প্রসাদপিতা  


ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের তিন সূক্ত কি অহৈতুকী  

হে বৃক্ষবাসী বিবস্বান-জাতক 

সংহর--- সংহর মহাচন্দ কালপুরুষকে  

অপরিচিতের মুখ 

রূপক সান্যাল 

পাশ ফিরে শোওয়া আমার আর হলো না 

নির্জনতা কিনে কিনে একদিন ফতুর হয়ে যাবো

শেকড় কিংবা শাখায়, কোথাও বাড়বৃদ্ধি নেই 

আমার কান্ড চিরেই একদিন আমাকে পোড়াবো


বাবাও জীবনভর এভাবেই নিজেকে পোড়ালো

শ্মশানের কাছে রয়ে গেছে মানুষের নিরবচ্ছিন্ন ঋণ 

একথা সবাই জানে, বর্তমান ক্রমশ অসহ্য হয়ে ওঠে 

বয়স বাড়ার সাথে অতীতকে মনে হয় দারুণ রঙিন 


দুপুর গড়িয়ে গেলে সকলেই পাশ ফিরে শুতে চায় 

নতুন দেওয়ালের গায়ে নিজস্ব নামটা লিখবো না?

কোনোদিন তোমার সামনে অস্পষ্ট শরীরে দাঁড়ালে 

জানি না, আদৌ আমাকে চিনতে পারবে কিনা?

অলঙ্করণ : দয়াময় বন্দ্যোপাধ্যায় 

ভ্রমণ

খাজিয়ার - মিনি সুইজারল্যান্ড 

পার্থ সারথি গোস্বামী 

কর্মসূত্রে তখন আমি জম্মু-কাশ্মীরে। জম্মুর বাসৌলি জেলায় ন্যাশনাল হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্রজেক্ট করপোরেশনের অন্তর্গত রবি নদীর ওপর দ্বিতীয় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প SEWA-II এর। বলতে গেলে বেশ চ্যালেঞ্জিং প্রজেক্ট, একটি ডাইভার্সনাল টানেলের মাধ্যমে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে প্রায় ২৩ কিমি দীর্ঘ টানেলের মাধ্যমে জল সোজা গিয়ে পড়বে টারবাইনের ওপর, টারবাইন প্রজেক্ট করা হবে হিমাচলপ্রদেশের খেইরি নামক স্থানে। সেখানেই তৈরি হবে পাওয়ার হাইস। যেহেতু প্রজেক্টটি যৌথ ভাবে জম্মু-কাশ্মীর ও হিমাচল প্রদেশের সঙ্গে সংযুক্ত, তাই সেখানে নানান বাধা নিষেধ থাকলেও ওই দুই রাজ্যেই আমাদের ছিল অবাধ যাতায়াত। সেই সুবাদে হিমাচলপ্রদেশ মোটামুটি ভাবে চষে দেখার সুযোগ হয়েছে। 

প্রজেক্টের কাজ ছাড়া বেশ একঘেয়ে জীবন। ঘুম ভেঙে উঠেই দেখি দূরের সব তুষার ধবল পর্বত শিখর, আবার চাঁদের আলোয় সেই বরফঢাকা পাহাড়ের মোহিনী রূপ দেখে ঘুমাতে যাওয়া। আমাদের প্রজেক্ট ম্যানেজার ছিলেন একজন বাঙালি, ভবানী শংকর মুখার্জী। প্রচন্ড দাপুটে মানুষ, ওয়াকিটকিতে ওনার বজ্রগম্ভীর গলা শুনলে অতি ফাঁকিবাজ ব্যক্তিও ছুটে এসে কাজে মন দিত। আবার অবসরে তিনি ছিলেন দিলখোলা মানুষ।আমাদের বলেই দিয়েছিলেন, চারিদিকে অপার সৌন্দর্য, সময় সুযোগ পেলেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়বে, এখানে না ঘুরলে কোথায় ঘুরবে আর, তবে হ্যাঁ অবশ্যই তা কাজের ক্ষতি না করে। 

আমাদের সাথে হিমাচলপ্রদেশের অনেক মানুষজন কাজ করতেন, তাদের মধ্যে মানহাস ছিল সিভিল সুপারভাইজার, সে মাঝে মাঝেই বলতো,

- সাব, ইতনা নজদিক মে সুইজারল্যান্ড, কমসে কম একদিন ঘুমকে তো আইয়ে।

একদিন অধৈর্য হয়ে বললাম,

- ক্যায়া বকরাহা হ্যায়, ইঁহা তেরেকো সুইজারল্যান্ড কাঁহাসে দেখাই দিয়া।

-আরে সাব, সাচ্চি। ডালহৌসি না নজদিক মে হি হ্যায়। খাজিয়ার, লোগ বোলতে হ্যায় 'মিনি সুইজারল্যান্ড'।

হাতের ইশারায় মানহাস দেখিয়ে দিল,

- উ দেখিয়ে, উ ডালহৌসি অর উসকি পারলি সাইড, থোড়া নীচে যাকে খাজিয়ার।

পাহাড়ের ব্যাপারটা সত্যিই অদ্ভুত, চোখে দেখে মনেহয় এই সামনেই, যেন লাফ দিয়ে পৌঁছে যাবো, আর পাহাড়ের গা বেয়ে সর্পিল রাস্তা ধরে ঘুরছি তো ঘুরছিই, পথের আর শেষ হতে চায়না, যেন পেটের মধ্যেকার নাড়িভুঁড়িতেও পাক লেগে যায় ।

কথাটা শুনেই মনটা কেমন যেন উড়ুউড়ু হয়ে গেল। আরো ভালোভাবে একে ওকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, সত্যিই অসম্ভব সুন্দর একটি জায়গা, লোকমুখে যা মিনি সুইজারল্যান্ড নামেই পরিচিত।

হাতের কাছে এমন সুন্দর জায়গা, আর সেটি ঘুরে আসবোনা, তাই হয় নাকি। 

শুরু হয়ে গেল প্লানিং, পুরো বাঙালি টিম, আমি, সুজনদা, দাসদা, তাপস , ভোলা আর এক মারাঠি রমেশ মাঙ্গলে মিলে বেরিয়ে পড়লাম এক ছুটির দিন সকাল সকাল। ড্রাইভার ছোট্টু বলল,

- দাদা রাস্তা তো যাদা নেহি, ৯৫ কিমি, লেকিন জানেমে কমসে কম চার ঘণ্টা লগ যায়েগা।

সর্পিল রাস্তা ধরে পৌঁছে গেলাম জম্মুকাশ্মীর ও হিমাচলের বর্ডার খেইরি। ওখানেই sewa-II এর পকওয়ার হাউস, সেখান থেকে আর এক মারাঠি মহেশ উঠে এলো আমাদের সঙ্গে।

আবার সেই সাপের বুকে পাক খেতে খেতে গাড়ি ওপরে চড়তে শুরু করলো। পৌঁছালাম ডালহৌসি। ডালহৌসি হিমাচলের একটি অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থান। অবশ্য আজ ডালহৌসি নিয়ে কোন কথা নয়, আমরা মিনি সুইজারল্যান্ডের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি, ডালহৌসি থেকে খাজিয়ার মাত্র ২২-২৩ কিমি রাস্তা, তাই মন আর তর সইছে না। 

এতক্ষণ ধরে গাড়ি ওপরে চড়ছিল, এখন নীচে নামা শুরু। প্রায় মিনিট চল্লিশ পর আমরা এসে পৌঁছালাম আমাদের কাঙ্খিত 'মিনি সুইজারল্যান্ড'।

সত্যিই চোখ জুড়িয়ে গেল। সমুদ্রতল থেকে প্রায় ২০০০ মিটার উচ্চতায় প্রায় ৩ বর্গ কিম জায়গা জুড়ে হিমালয়ান দেওদার, পাইন, ওক ঘেরা ছোট্ট এক অনন্য সুন্দর উপত্যকা। যার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফেরানো ভীষন ভীষন কঠিন। কোলাহল বর্জিত সবুজ ঘাসের গালিচা বিছানো এক নৈশ্বর্গিক স্থল। 

উপত্যকার ঠিক মধ্যস্থলে একটি হ্রদ, যার চারপাশ মোড়া সবুজ ঘাসের কার্পেটে। দেখে মনে হবে সবুজ কার্পেটে মোড়া উপত্যকাটি পাহারা দিচ্ছে সারি সারি দেওদার, পাইন, ওকের নিবিড় অরণ্য, আর অরণ্যের শেষে চতুর্দিকেই বরফে মোড়া রজতশুভ্র পর্বতশৃঙ্গ। হ্রদের একপাশে রয়েছে কয়েকটি হোটেল ও ফাস্ট ফুডের স্টল। এতদিন একটানা পাহাড়ের পাথর আর টানেলের অন্ধকার ছেড়ে মুক্ত পরিবেশে এমন সবুজ ঘাসের গালিচা দেশে আনন্দে গড়িয়ে নিলাম খানিক্ষণ। মনে হতে লাগল আমরা যেন পৃথিবীর সমস্ত কোলাহল থেকে দূরে অন্য কোন এক নির্জন সবুজ গ্রহে নির্জনতার সঙ্গে যাপন করছি। তাই স্থানটিকে মিনি সুইজারল্যান্ড বলা কোন অত্যুক্তি নয়।

ছোট্ট হ্রদটিও বেশ সুন্দর, হ্রদের বুকে এখানে সেখানে শ্যাওলার স্তুপ মাথা উঁচু করে আছে দ্বীপের মতো। দূর থেকে দেখে মনে হল হ্রদের গভীরতা ৪-৫ মিটারের বেশি নয়, কিন্তু স্থানীয়রা বললেন শুনে সত্যি অবাক হতে হয়,  হ্রদের গভীরতা নাকি ৫০০ মিটার। কথিত আছে এই হ্রদের জলে বাস করতেন খাজিয়া নাগ, সেই থেকেই স্থানটির নাম হয়েছে খাজিয়ার। হ্রদের উত্তর দিকে অদূরেই অবস্থিত খাজিয়া নাগের মন্দির। 

আসার পর থেকেই লক্ষ করছি, সবুজ উপত্যকা থেকে সরু একটি সাঁকো নেমে গেছে হ্রদের মধ্যিখান পর্যন্ত। আর সেখান থেকে দুদিকে দুটি মাচার মত জায়গা। অনেকে আবার বসেও আছে ওই মাচায়। মন কেবল বলছে 'দেখে যেন মনেহয় চিনি উহারে', এখানে এর আগে কোনদিন আসিনি, কিন্তু ওই সাঁকোটি দেখে খালি মনে হচ্ছে এই জায়গা আমি আগে কোথাও দেখেছি। মনটা কেমন যেন খচখচ করছে, শেষে ফাস্টফুড খেতে খেতে স্টলের ছেলেটিকে বলেই ফেললাম, সাঁকোটি দেখে জায়গাটা কেমন যেন চেনা চেনা ঠেকছে। ছেলেটি বলল,

 - আরে সাব, 'কুছ কুছ হোতা হ্যায়' নেহি দেখা ক্যায়া! উস ফিলিম মে 'সামার ক্যাম্প' বালা শুটিং তো ইঁহাপে হি  হুয়াতা। সেট বনায়া গয়া থা। তবসে ও পুলিয়া হ্যায় ইস লেক মে। 

সেটাই তো। বার বার মনে হচ্ছিল সাঁকোটা কোথায় যেন দেখা, মনে পড়ে গেল শাহরুখ-কাজলের সামার ক্যাম্পের দৃশ্য।

উপত্যকা, হ্রদ, অরণ্য ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা নেমে এল। চাঁদ উঠলো আকাশে, সমস্ত নিবিড় অরণ্য জুড়ে একটানা ঝিঁঝির ডাক, আর দূরে চোখ তুলে তাকালে চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত বরফে মোড়া পাহাড়ের অবর্ণনীয় রূপ। সত্যিই মন, বুক, চোখ সব জুড়িয়ে গেল। 

এবার ফেরার পালা, রাত্রিবাস করবো ডালহৌসিতে। গাড়িতে ওঠার আগে ওই নৈশ্বর্গিক সৌন্দর্য চোখ দিয়ে চেটে পুটে নিলাম আর একবার, নিজের মনেই গুনগুন করে উঠলাম,

 'তারিফ করু ক্যায়া উসকি, জিসনে তুমহে বনায়া'।।

বই আলোচনা

আবার পুরী সিরিজ (১৯৭৮) :এক নাবিকের নির্জন বেলাভূমি। 

অভিষেক সৎপথী

উৎপলকুমার বসুর "আবার পুরী সিরিজ"এর কবিতা যখন পড়ি তখন মনে হয় কবি  নিয়ে গেছেন বেলাভূমির নির্জন এক প্রান্তরে,চোখ বুজে অনুভব করা যায় কিছু শব্দ লহরী, নোনা হাওয়ায় মতো অসমাপ্ত কিছু টুকরো টুকরো কথা,একটার পর একটা ঢেউয়ের মতো  এগিয়ে আসে অনেকগুলো ছবি চিত্রপট। এইসব চিত্রকল্প বা 'ইমেজারি' কখনও রেঁমব্রার ছবির মতো আলো আঁধারিতে ফুটে ওঠে, কখনও কখনও সেই ছবি হয়ে যায় অসম্পূর্ণ।অবশিষ্ট রসাস্বাদন নিমিত্তে পাঠকেই উদ্যাগী হয়ে তুলি ধরতে হয়। 


তাঁর কবিতাগুলি সমুদ্রের মতোই আদিঅন্তহীন রহস্যময়, পাঠককে কখনও কখনও থমকে যেতে হয়, 

বিশ্বাস নিয়ে ফিরে আসতে হয় আগের পঙক্তি মালায়।কবির শব্দচয়ন আর প্রয়োগ কৌশল যেন ঝিনুকের মধ্যে মুক্তো সংগ্রহ। পেঁয়াজের খোসার মতোই সেই ভাষাশৈলী, আলাদা আলাদা স্তর সেখানে পাঠকের জন্য উন্মুক্ত। লবনের তারতম্যে যেমন সমুদ্রের জলের রং পালটে যায় সেইভাবেই বদলে যায় তাঁর কবিতার অন্তর্বয়ন। 

"তোমাদের বিচালিগাদায় আমাকে দিয়েছে ঘর –গ্রীষ্মে এতে আগুন লাগাব জেনো,এই /

গ্রীষ্মে –আমি নিরুপায় – তোমাকে লাফিয়ে যেতে দেখব তোমার পুকুরের জল ডিঙিটির /

দিকে – তোমার অস্বাভাবিক খাঁচার চকোরগুলি নষ্ট হবে হোক- পুকুরের শাপলায়/

 তুমি নষ্ট হও" (আগুন আগুন) 


উৎপলকুমার বসুর লেখায় জীবনানন্দীয় শৈলী  কখনও কখনও সকালের ছায়ার মতো দীর্ঘতর হয় অথচ কবির স্বকীয় সচেতন বুননে তার প্রসাদগুণ থাকে অক্ষুণ্ন:

"পাতা কুড়ানো খেলা তোমার, প্রবঞ্চনা-পাখির ঘর খেলাচ্ছলে নষ্ট করা-হাতে সেলাই ঝাড়লন্ঠন-শানবাঁধানো বনের তলা-বিয়ের দিনে কাটা মৃগেল-খেলা তোমার নষ্ট হোক-আমরা উঠি সমতলে-আমরা উঠি উপত্যকায়-যেখানে নীল রবার গাছ, গন্ধতেল- দু'চারদিন স্নান সাবান বন্ধ আছে- জ্যোৎস্না নেই - জ্যোৎস্নালোকে দাঁড়িয়ে থাকা করুণাহত সেলুনগাড়ি একা একাই দাঁড়িয়ে আছে মালগুদামে-" ( আগুন আগুন) 

কিংবা

" এবার হেমন্তে আমি  হলুদ পাতার নীচে ছুঁয়ে দেখছি

নমনীয় নব-আবিষ্কৃত এক ধাতু, 

তার স্প্রিং,তার প্রসারণশীলতায় আমি আগামী বসন্ত অবধি লাফাতে চেয়েছি,আমি ছুঁয়ে দেখছি গাছের

সবুজ পাতার ভিতরে বয়ে যাচ্ছে ছল ছল শব্দে নিশান,সে-ই বহন করে নিয়ে চলেছে  শত শত আলপিন -শিকড় থেকে ফুলের জানুর  ভিতর অব্দি।"   

 (রঙিন সান্তাল ছবির বিচ্ছুরিত পিতল) 

"রা-রা-রা ডিমোক্রেসি" কবিতায় দেখতে পাই সমসাময়িক বাস্তবতা,সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন এক গল্প। 

"মাতালদের সঙ্গে  ধূলোর রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া অপরাহ্নে বেশ্যাপাড়ার দিকে আমাকে /

ক্রমশ তন্দ্রাচ্ছন্ন করে তোলে এবং মাছির কথা ভুলিনি-সেজন্য দু'মুহূর্ত মিষ্টান্ন-ভাণ্ডার/

 দাঁড়াতে হল-বেলার জন্য কচুরি এবং অপরাহ্নেই আমি ব্রণসমেত  বেলাকে পেতে চাই/

বাথরুমের ভিতরে"

"আমার ভিতরে তখন  বাঁশির নিরাপত্তাবোধ  জেগে উঠেছে এবং প্রত্যেককে জড়িয়ে/

 ধরে সুরেন মাতাল বলছে: ভাই, আমার ভাই"

আবার কখনো প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতবাহী, 

" শান্তি বেগমের কাছে দু'টি বাঘ বসে আছে চুপে। 

একটি পুরুষ আরেকটির ভঙ্গি দেখে বোঝা দায়

ও কি পুরুষ না মেয়ে ছেলে" (ছিল চাঁদ,যাব বহুদূর) 

আবার "দাঙ্গা" কবিতায় দেখি:

" মেষপালকের মৃতদেহের  উপর ক্রন্দনরত ভগবান শ্রীকৃষ্ণ-

এবং আগেই বলে রাখা ভালো 

আমি চাষিদের সঙ্গে মেলামেশা করতাম এই ভেবে যে

তারা মধ্যবিত্তদের চেয়ে অধিকতর জটিল

ও পরিসংখ্যানজাত-"

অসংখ্য চিত্রকল্প,বস্তুনিষ্ঠ বর্ননা যখন সংকেতধর্মী হয় এবং সৃষ্টি করে দোলাচল:

"সমুদ্রতীরকে তুমি বিদায় জানাও! বলো:বিদায় ঝাউয়ের বন বলো:যজ্ঞোপবীত

ছিঁড়ে ফেলে:বিদায় সেনানী বিদায় জরিপঘর,হিত ও অহিত

নষ্ট হোক,ভেঙে যাক বাতাস,গরিমা,ঢেউ, প্রচারকৌশল" (তাম্বুলের ডালা) 

উৎপলকুমার বসুর কবিতা পুরনো অথচ নতুন অভিনব শব্দে সমৃদ্ধ,অনেক সময় অর্থহীন মনে হয়, মনে হয় রস গ্রহণে অক্ষম। তাঁর কবিতা একবার পড়লে আর একবার পড়তে মন যায়। রেশটুকু থেকে যায়। পাঠকের ধৈর্য্য আর অধ্যবসায় কবির মননের কাছাকাছি পৌঁছতে সাহায্য করে।সেই জগৎ আপেক্ষিক, ক্রিটিকের মতে " আকার সর্বস্ব "! 

Friday, August 14, 2020

বিজ্ঞাপন

  ভিডিওটি দেখুন