আবার পুরী সিরিজ (১৯৭৮) :এক নাবিকের নির্জন বেলাভূমি।
অভিষেক সৎপথী
উৎপলকুমার বসুর "আবার পুরী সিরিজ"এর কবিতা যখন পড়ি তখন মনে হয় কবি নিয়ে গেছেন বেলাভূমির নির্জন এক প্রান্তরে,চোখ বুজে অনুভব করা যায় কিছু শব্দ লহরী, নোনা হাওয়ায় মতো অসমাপ্ত কিছু টুকরো টুকরো কথা,একটার পর একটা ঢেউয়ের মতো এগিয়ে আসে অনেকগুলো ছবি চিত্রপট। এইসব চিত্রকল্প বা 'ইমেজারি' কখনও রেঁমব্রার ছবির মতো আলো আঁধারিতে ফুটে ওঠে, কখনও কখনও সেই ছবি হয়ে যায় অসম্পূর্ণ।অবশিষ্ট রসাস্বাদন নিমিত্তে পাঠকেই উদ্যাগী হয়ে তুলি ধরতে হয়।
তাঁর কবিতাগুলি সমুদ্রের মতোই আদিঅন্তহীন রহস্যময়, পাঠককে কখনও কখনও থমকে যেতে হয়,
বিশ্বাস নিয়ে ফিরে আসতে হয় আগের পঙক্তি মালায়।কবির শব্দচয়ন আর প্রয়োগ কৌশল যেন ঝিনুকের মধ্যে মুক্তো সংগ্রহ। পেঁয়াজের খোসার মতোই সেই ভাষাশৈলী, আলাদা আলাদা স্তর সেখানে পাঠকের জন্য উন্মুক্ত। লবনের তারতম্যে যেমন সমুদ্রের জলের রং পালটে যায় সেইভাবেই বদলে যায় তাঁর কবিতার অন্তর্বয়ন।
"তোমাদের বিচালিগাদায় আমাকে দিয়েছে ঘর –গ্রীষ্মে এতে আগুন লাগাব জেনো,এই /
গ্রীষ্মে –আমি নিরুপায় – তোমাকে লাফিয়ে যেতে দেখব তোমার পুকুরের জল ডিঙিটির /
দিকে – তোমার অস্বাভাবিক খাঁচার চকোরগুলি নষ্ট হবে হোক- পুকুরের শাপলায়/
তুমি নষ্ট হও" (আগুন আগুন)
উৎপলকুমার বসুর লেখায় জীবনানন্দীয় শৈলী কখনও কখনও সকালের ছায়ার মতো দীর্ঘতর হয় অথচ কবির স্বকীয় সচেতন বুননে তার প্রসাদগুণ থাকে অক্ষুণ্ন:
"পাতা কুড়ানো খেলা তোমার, প্রবঞ্চনা-পাখির ঘর খেলাচ্ছলে নষ্ট করা-হাতে সেলাই ঝাড়লন্ঠন-শানবাঁধানো বনের তলা-বিয়ের দিনে কাটা মৃগেল-খেলা তোমার নষ্ট হোক-আমরা উঠি সমতলে-আমরা উঠি উপত্যকায়-যেখানে নীল রবার গাছ, গন্ধতেল- দু'চারদিন স্নান সাবান বন্ধ আছে- জ্যোৎস্না নেই - জ্যোৎস্নালোকে দাঁড়িয়ে থাকা করুণাহত সেলুনগাড়ি একা একাই দাঁড়িয়ে আছে মালগুদামে-" ( আগুন আগুন)
কিংবা
" এবার হেমন্তে আমি হলুদ পাতার নীচে ছুঁয়ে দেখছি
নমনীয় নব-আবিষ্কৃত এক ধাতু,
তার স্প্রিং,তার প্রসারণশীলতায় আমি আগামী বসন্ত অবধি লাফাতে চেয়েছি,আমি ছুঁয়ে দেখছি গাছের
সবুজ পাতার ভিতরে বয়ে যাচ্ছে ছল ছল শব্দে নিশান,সে-ই বহন করে নিয়ে চলেছে শত শত আলপিন -শিকড় থেকে ফুলের জানুর ভিতর অব্দি।"
(রঙিন সান্তাল ছবির বিচ্ছুরিত পিতল)
"রা-রা-রা ডিমোক্রেসি" কবিতায় দেখতে পাই সমসাময়িক বাস্তবতা,সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন এক গল্প।
"মাতালদের সঙ্গে ধূলোর রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া অপরাহ্নে বেশ্যাপাড়ার দিকে আমাকে /
ক্রমশ তন্দ্রাচ্ছন্ন করে তোলে এবং মাছির কথা ভুলিনি-সেজন্য দু'মুহূর্ত মিষ্টান্ন-ভাণ্ডার/
দাঁড়াতে হল-বেলার জন্য কচুরি এবং অপরাহ্নেই আমি ব্রণসমেত বেলাকে পেতে চাই/
বাথরুমের ভিতরে"
"আমার ভিতরে তখন বাঁশির নিরাপত্তাবোধ জেগে উঠেছে এবং প্রত্যেককে জড়িয়ে/
ধরে সুরেন মাতাল বলছে: ভাই, আমার ভাই"
আবার কখনো প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতবাহী,
" শান্তি বেগমের কাছে দু'টি বাঘ বসে আছে চুপে।
একটি পুরুষ আরেকটির ভঙ্গি দেখে বোঝা দায়
ও কি পুরুষ না মেয়ে ছেলে" (ছিল চাঁদ,যাব বহুদূর)
আবার "দাঙ্গা" কবিতায় দেখি:
" মেষপালকের মৃতদেহের উপর ক্রন্দনরত ভগবান শ্রীকৃষ্ণ-
এবং আগেই বলে রাখা ভালো
আমি চাষিদের সঙ্গে মেলামেশা করতাম এই ভেবে যে
তারা মধ্যবিত্তদের চেয়ে অধিকতর জটিল
ও পরিসংখ্যানজাত-"
অসংখ্য চিত্রকল্প,বস্তুনিষ্ঠ বর্ননা যখন সংকেতধর্মী হয় এবং সৃষ্টি করে দোলাচল:
"সমুদ্রতীরকে তুমি বিদায় জানাও! বলো:বিদায় ঝাউয়ের বন বলো:যজ্ঞোপবীত
ছিঁড়ে ফেলে:বিদায় সেনানী বিদায় জরিপঘর,হিত ও অহিত
নষ্ট হোক,ভেঙে যাক বাতাস,গরিমা,ঢেউ, প্রচারকৌশল" (তাম্বুলের ডালা)
উৎপলকুমার বসুর কবিতা পুরনো অথচ নতুন অভিনব শব্দে সমৃদ্ধ,অনেক সময় অর্থহীন মনে হয়, মনে হয় রস গ্রহণে অক্ষম। তাঁর কবিতা একবার পড়লে আর একবার পড়তে মন যায়। রেশটুকু থেকে যায়। পাঠকের ধৈর্য্য আর অধ্যবসায় কবির মননের কাছাকাছি পৌঁছতে সাহায্য করে।সেই জগৎ আপেক্ষিক, ক্রিটিকের মতে " আকার সর্বস্ব "!
No comments:
Post a Comment