খাজিয়ার - মিনি সুইজারল্যান্ড
পার্থ সারথি গোস্বামী
কর্মসূত্রে তখন আমি জম্মু-কাশ্মীরে। জম্মুর বাসৌলি জেলায় ন্যাশনাল হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্রজেক্ট করপোরেশনের অন্তর্গত রবি নদীর ওপর দ্বিতীয় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প SEWA-II এর। বলতে গেলে বেশ চ্যালেঞ্জিং প্রজেক্ট, একটি ডাইভার্সনাল টানেলের মাধ্যমে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে প্রায় ২৩ কিমি দীর্ঘ টানেলের মাধ্যমে জল সোজা গিয়ে পড়বে টারবাইনের ওপর, টারবাইন প্রজেক্ট করা হবে হিমাচলপ্রদেশের খেইরি নামক স্থানে। সেখানেই তৈরি হবে পাওয়ার হাইস। যেহেতু প্রজেক্টটি যৌথ ভাবে জম্মু-কাশ্মীর ও হিমাচল প্রদেশের সঙ্গে সংযুক্ত, তাই সেখানে নানান বাধা নিষেধ থাকলেও ওই দুই রাজ্যেই আমাদের ছিল অবাধ যাতায়াত। সেই সুবাদে হিমাচলপ্রদেশ মোটামুটি ভাবে চষে দেখার সুযোগ হয়েছে।
প্রজেক্টের কাজ ছাড়া বেশ একঘেয়ে জীবন। ঘুম ভেঙে উঠেই দেখি দূরের সব তুষার ধবল পর্বত শিখর, আবার চাঁদের আলোয় সেই বরফঢাকা পাহাড়ের মোহিনী রূপ দেখে ঘুমাতে যাওয়া। আমাদের প্রজেক্ট ম্যানেজার ছিলেন একজন বাঙালি, ভবানী শংকর মুখার্জী। প্রচন্ড দাপুটে মানুষ, ওয়াকিটকিতে ওনার বজ্রগম্ভীর গলা শুনলে অতি ফাঁকিবাজ ব্যক্তিও ছুটে এসে কাজে মন দিত। আবার অবসরে তিনি ছিলেন দিলখোলা মানুষ।আমাদের বলেই দিয়েছিলেন, চারিদিকে অপার সৌন্দর্য, সময় সুযোগ পেলেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়বে, এখানে না ঘুরলে কোথায় ঘুরবে আর, তবে হ্যাঁ অবশ্যই তা কাজের ক্ষতি না করে।
আমাদের সাথে হিমাচলপ্রদেশের অনেক মানুষজন কাজ করতেন, তাদের মধ্যে মানহাস ছিল সিভিল সুপারভাইজার, সে মাঝে মাঝেই বলতো,
- সাব, ইতনা নজদিক মে সুইজারল্যান্ড, কমসে কম একদিন ঘুমকে তো আইয়ে।
একদিন অধৈর্য হয়ে বললাম,
- ক্যায়া বকরাহা হ্যায়, ইঁহা তেরেকো সুইজারল্যান্ড কাঁহাসে দেখাই দিয়া।
-আরে সাব, সাচ্চি। ডালহৌসি না নজদিক মে হি হ্যায়। খাজিয়ার, লোগ বোলতে হ্যায় 'মিনি সুইজারল্যান্ড'।
হাতের ইশারায় মানহাস দেখিয়ে দিল,
- উ দেখিয়ে, উ ডালহৌসি অর উসকি পারলি সাইড, থোড়া নীচে যাকে খাজিয়ার।
পাহাড়ের ব্যাপারটা সত্যিই অদ্ভুত, চোখে দেখে মনেহয় এই সামনেই, যেন লাফ দিয়ে পৌঁছে যাবো, আর পাহাড়ের গা বেয়ে সর্পিল রাস্তা ধরে ঘুরছি তো ঘুরছিই, পথের আর শেষ হতে চায়না, যেন পেটের মধ্যেকার নাড়িভুঁড়িতেও পাক লেগে যায় ।
কথাটা শুনেই মনটা কেমন যেন উড়ুউড়ু হয়ে গেল। আরো ভালোভাবে একে ওকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, সত্যিই অসম্ভব সুন্দর একটি জায়গা, লোকমুখে যা মিনি সুইজারল্যান্ড নামেই পরিচিত।
হাতের কাছে এমন সুন্দর জায়গা, আর সেটি ঘুরে আসবোনা, তাই হয় নাকি।
শুরু হয়ে গেল প্লানিং, পুরো বাঙালি টিম, আমি, সুজনদা, দাসদা, তাপস , ভোলা আর এক মারাঠি রমেশ মাঙ্গলে মিলে বেরিয়ে পড়লাম এক ছুটির দিন সকাল সকাল। ড্রাইভার ছোট্টু বলল,
- দাদা রাস্তা তো যাদা নেহি, ৯৫ কিমি, লেকিন জানেমে কমসে কম চার ঘণ্টা লগ যায়েগা।
সর্পিল রাস্তা ধরে পৌঁছে গেলাম জম্মুকাশ্মীর ও হিমাচলের বর্ডার খেইরি। ওখানেই sewa-II এর পকওয়ার হাউস, সেখান থেকে আর এক মারাঠি মহেশ উঠে এলো আমাদের সঙ্গে।
আবার সেই সাপের বুকে পাক খেতে খেতে গাড়ি ওপরে চড়তে শুরু করলো। পৌঁছালাম ডালহৌসি। ডালহৌসি হিমাচলের একটি অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থান। অবশ্য আজ ডালহৌসি নিয়ে কোন কথা নয়, আমরা মিনি সুইজারল্যান্ডের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি, ডালহৌসি থেকে খাজিয়ার মাত্র ২২-২৩ কিমি রাস্তা, তাই মন আর তর সইছে না।
এতক্ষণ ধরে গাড়ি ওপরে চড়ছিল, এখন নীচে নামা শুরু। প্রায় মিনিট চল্লিশ পর আমরা এসে পৌঁছালাম আমাদের কাঙ্খিত 'মিনি সুইজারল্যান্ড'।
সত্যিই চোখ জুড়িয়ে গেল। সমুদ্রতল থেকে প্রায় ২০০০ মিটার উচ্চতায় প্রায় ৩ বর্গ কিম জায়গা জুড়ে হিমালয়ান দেওদার, পাইন, ওক ঘেরা ছোট্ট এক অনন্য সুন্দর উপত্যকা। যার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফেরানো ভীষন ভীষন কঠিন। কোলাহল বর্জিত সবুজ ঘাসের গালিচা বিছানো এক নৈশ্বর্গিক স্থল।
উপত্যকার ঠিক মধ্যস্থলে একটি হ্রদ, যার চারপাশ মোড়া সবুজ ঘাসের কার্পেটে। দেখে মনে হবে সবুজ কার্পেটে মোড়া উপত্যকাটি পাহারা দিচ্ছে সারি সারি দেওদার, পাইন, ওকের নিবিড় অরণ্য, আর অরণ্যের শেষে চতুর্দিকেই বরফে মোড়া রজতশুভ্র পর্বতশৃঙ্গ। হ্রদের একপাশে রয়েছে কয়েকটি হোটেল ও ফাস্ট ফুডের স্টল। এতদিন একটানা পাহাড়ের পাথর আর টানেলের অন্ধকার ছেড়ে মুক্ত পরিবেশে এমন সবুজ ঘাসের গালিচা দেশে আনন্দে গড়িয়ে নিলাম খানিক্ষণ। মনে হতে লাগল আমরা যেন পৃথিবীর সমস্ত কোলাহল থেকে দূরে অন্য কোন এক নির্জন সবুজ গ্রহে নির্জনতার সঙ্গে যাপন করছি। তাই স্থানটিকে মিনি সুইজারল্যান্ড বলা কোন অত্যুক্তি নয়।
ছোট্ট হ্রদটিও বেশ সুন্দর, হ্রদের বুকে এখানে সেখানে শ্যাওলার স্তুপ মাথা উঁচু করে আছে দ্বীপের মতো। দূর থেকে দেখে মনে হল হ্রদের গভীরতা ৪-৫ মিটারের বেশি নয়, কিন্তু স্থানীয়রা বললেন শুনে সত্যি অবাক হতে হয়, হ্রদের গভীরতা নাকি ৫০০ মিটার। কথিত আছে এই হ্রদের জলে বাস করতেন খাজিয়া নাগ, সেই থেকেই স্থানটির নাম হয়েছে খাজিয়ার। হ্রদের উত্তর দিকে অদূরেই অবস্থিত খাজিয়া নাগের মন্দির।
আসার পর থেকেই লক্ষ করছি, সবুজ উপত্যকা থেকে সরু একটি সাঁকো নেমে গেছে হ্রদের মধ্যিখান পর্যন্ত। আর সেখান থেকে দুদিকে দুটি মাচার মত জায়গা। অনেকে আবার বসেও আছে ওই মাচায়। মন কেবল বলছে 'দেখে যেন মনেহয় চিনি উহারে', এখানে এর আগে কোনদিন আসিনি, কিন্তু ওই সাঁকোটি দেখে খালি মনে হচ্ছে এই জায়গা আমি আগে কোথাও দেখেছি। মনটা কেমন যেন খচখচ করছে, শেষে ফাস্টফুড খেতে খেতে স্টলের ছেলেটিকে বলেই ফেললাম, সাঁকোটি দেখে জায়গাটা কেমন যেন চেনা চেনা ঠেকছে। ছেলেটি বলল,
- আরে সাব, 'কুছ কুছ হোতা হ্যায়' নেহি দেখা ক্যায়া! উস ফিলিম মে 'সামার ক্যাম্প' বালা শুটিং তো ইঁহাপে হি হুয়াতা। সেট বনায়া গয়া থা। তবসে ও পুলিয়া হ্যায় ইস লেক মে।
সেটাই তো। বার বার মনে হচ্ছিল সাঁকোটা কোথায় যেন দেখা, মনে পড়ে গেল শাহরুখ-কাজলের সামার ক্যাম্পের দৃশ্য।
উপত্যকা, হ্রদ, অরণ্য ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা নেমে এল। চাঁদ উঠলো আকাশে, সমস্ত নিবিড় অরণ্য জুড়ে একটানা ঝিঁঝির ডাক, আর দূরে চোখ তুলে তাকালে চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত বরফে মোড়া পাহাড়ের অবর্ণনীয় রূপ। সত্যিই মন, বুক, চোখ সব জুড়িয়ে গেল।
এবার ফেরার পালা, রাত্রিবাস করবো ডালহৌসিতে। গাড়িতে ওঠার আগে ওই নৈশ্বর্গিক সৌন্দর্য চোখ দিয়ে চেটে পুটে নিলাম আর একবার, নিজের মনেই গুনগুন করে উঠলাম,
'তারিফ করু ক্যায়া উসকি, জিসনে তুমহে বনায়া'।।
No comments:
Post a Comment